জাতীয় সংগীতের দেশাত্মবোধক সুর ও কথায় আবেগেপ্রবণ হয়ে ওঠেন সকলেই। বিখ্যাত থেকে থেকে অখ্যাত সাধারণ মানুষ, এক্ষেত্রে সকলেই এক। সেই জাতীয় সংগীতের কথাটাই যদি না থাকে? স্পেনের জাতীয় সংগীত কিন্তু তাই। কেবলই সুর, কথা নেই। কেন এমন? কী বলছে ইতিহাস?
জাতীয় সংগীত রচনার বিষয়ে তাঁর তুলনা নেই৷ তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর৷ সকলের জানা, নোবেল জয়ী কবি দু’দুটি দেশের জাতীয় সংগীত রচনা করেছেন৷ ভারতের ও বাংলাদেশের। তবে সবার হয়তো জানা নেই, যে শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীতটিও রবীন্দ্রনাথেরই সৃষ্টি৷ মূল কথা ও সুর বাঙালি কবিরই৷ তবে, রবীন্দ্রনাথের লেখা “নম নম শ্রীলঙ্কা মাতা” গানটি সিংহলি কবি অনন্দ সমরকুনের সিংহলি অনুবাদে হয়ে যায় “আপা শ্রীলঙ্কা, নম নম নম নম মাতা”৷ একজন কবি তিনটি দেশের জাতীয় সংগীত রচনা করেছেন! এই ঘটনা কিন্তু যথেষ্ট অবাক করা৷ জাতীয় সংগীতের ক্ষেত্রে আরও এক কাণ্ড জানলে বেশ আশ্চর্য লাগে৷ যেমন ধরুন, স্পেন-সহ বিশ্বের চারটি দেশের জাতীয় সংগীতে কথাটাই নেই৷ আছে কেবল সুর। কেন নেই কথা? কেন শুধুই সুর?
এর পেছনে একটা ইতিহাস আছে। আসলে স্পেনের জাতীয় সংগীতকে বলা হয় ‘মার্সা রিয়েল’৷ বাংলা করলে দাঁড়ায় রাজকীয় কুচকাওয়াজ৷ ঐতিহাসিকদের মতে, বর্তমান জার্মানির অন্তর্গত প্রাশিয়ার রাজা ফ্রেডরিক দ্বিতীয় ‘মার্সা রিয়েল’-এর স্রষ্টা৷ সংগীতটি জনসমক্ষে আসে ১৮৬১ সালে৷ দ্রুত তুমুল জনপ্রিয়তা পায়৷ এই সময় স্পেনের রাজা চার্লস এক যোদ্ধাকে পাঠান ফ্রেডরিক দ্বিতীয়র কাছে৷ যার নাম ছিল তৃতীয় জুয়ান মার্টিন। উন্নত সামরিক কৌশল শিখতে এলেও জুয়ান ফেরার সময় মার্সা রিয়ালের স্বরলিপি সঙ্গে নিয়ে আসেন স্পেনে৷ আসলে গানটিকে উপহার হিসেবে স্পেনের রাজার কাছে পাঠান ফ্রেডরিক দ্বিতীয় স্বয়ং৷ এরপর স্পেনেও একইরকম জনপ্রিয় হয়ে ওঠে মার্সা রিয়েল৷ রাজ পরিবারের তো বটেই, গোটা দেশের জনতা ভালবেসে ফেলে সংগীতটিকে৷
আরও শুনুন: ভিনগ্রহই ভবিষ্যৎ… মঙ্গল ছাড়িয়ে এবার বুধে পা দেওয়ার স্বপ্ন মানুষের
একদল ঐতিহাসিক মনে করেন, এর খানিক আগে, রানি ইসাবেলা দ্বিতীয় মার্সা রিয়েলকে জাতীয় সংগীতের মর্যাদা দেন৷ কিন্তু, আসল কথাটি হল, মার্সা রিয়েলের সুর পছন্দ হলেও কথা নিয়ে কিন্তু নানা কাণ্ড ঘটতে থাকে৷ আসলে অত প্রিয় সুর, অথচ কথা পছন্দ হচ্ছিল না রাজার ও প্রজাদের৷ যদিও এর মধ্যে বহু কথাকার মার্সা রিয়েলের কথা লেখার চেষ্টা করেছেন। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তা গাওয়াও হয়েছে, তবে শেষ পর্যন্ত কিন্তু ধোপে টেকেনি৷ সাম্প্রতিক অতীতে স্পেনের ইতিহাস খ্যাত সেনাপ্রধান জেনরেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর ইচ্ছা অনুযায়ী ১৯৭৮ সালে কথা ছাড়া কেবল সুরটিকেই জাতীয় সংগীতের মর্যাদা দেওয়া হয়৷ তারপর থেকে বিশ্ব ফুটবলের আসরে হোক কিংবা রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে, শুধুই সুরেই বেজে থাকে স্পেনের জাতীয় সংগীত!
তবে, কথার সন্ধান কিন্তু থামেনি৷ সম্প্রতি, মানে ২০০৭ সালেও মার্সা রিয়েলের জন্য কথা আহ্বান করা হয় জাতীয় স্তরে৷ এবারও তীব্র উৎসাহ তৈরি হয় দেশে৷ এক ডাকে ৭ হাজার কথা জমা পড়ে৷ কিন্তু হায়! আগের মতোই এবারও কথা পছন্দ হয়নি সর্বসম্মতিক্রমে৷ স্পেন ছাড়াও সান মারিনা, কসোভো ও বসনিয়া-হার্জিগোভিনার ব্যাপারটাও এক৷ এদেরও জাতীয় সংগীত মানে কেবলই সুর৷ কথা নেই। সবার তো আর রবীন্দ্রনাথ থাকে না!