স্বর্গলোকের সকল দেবদেবীরই একটি নির্দিষ্ট বাহন থাকে। কিছু ব্যতিক্রম থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই বাহন নির্বাচন করা হয় দেবতার আয়তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই। তেমনই দেবী দুর্গার বাহন পশুরাজ সিংহ। আয়তন আর ক্ষমতায় সে প্রকৃতই দেবীকে বহন করে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে উপযুক্ত ও যোগ্য। কিন্তু কেবলমাত্র সেই কারণেই দেবী মহামায়াকে বহন করার সৌভাগ্য লাভ হয়নি তাঁর। নেপথ্যে রয়েছে আরও কিছু ব্যাখ্যা। আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
মহিষাসুর বধের উদ্দেশ্য নিয়েই সৃষ্টি করা হয়েছিল দেবী দুর্গার। অস্ত্রহীন নিরাভরণ সেই দেবীকে নিজেদের শক্তি দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছিলেন সমগ্র দেবকুল। তখনই দেবীর বাহন হিসেবে সিংহ উপহার দিয়েছিলেন গিরিরাজ হিমালয়। সেকথার উল্লেখ শ্রী শ্রী চন্ডীতেও রয়েছে। তবে কালিকাপুরাণ মতে দেবীর এই বাহন বৃত্তান্তের এক অন্য ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। অভিধানে সিংহের এক অন্য অর্থ হিসেবে উল্লেখ পাওয়া যায় হরি শব্দটির। আবার হরি অর্থে স্বয়ং নারায়ণকেও বোঝানো হয়। সেই সূত্র ধরেই বলা হয় হরি-রূপে স্বয়ং নারায়ণ জগৎসংসারের সামনে বহন করেন দেবীকে।
আরও শুনুন: এত বড় চেহারায় গণেশের বাহন এইটুকু ইঁদুর! নেপথ্যে রয়েছে কী কারণ?
আবার আধ্যাত্মিকতার দিক থেকেও বিচার করলে দেখা যাবে, অসীম শক্তিশালী সিংহ দেবীর চরণে অনায়াসেই আত্মসর্মপণ করেছে। পশুত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে দেবত্বে উন্নীত হওয়াই যে সকলের একান্ত কামনা। তাই মাতৃচরণে আত্মসমর্পণ। সিংহ পশুশ্রেষ্ঠ হয়েও দেবশক্তির আধার হয়েছে শুধু দেবীর শরণাগতির প্রভাবেই। অপর দিকে দেবীর লক্ষ্য লোককল্যাণ। সত্ত্বগুণময়ী মা রজোগুণময়ী সিংহকে বাহন হিসাবে নিয়ন্ত্রণ করে লোকস্থিতি রক্ষা করছেন। রজোগুণের সঙ্গে তমোগুণের সমন্বয় ঘটলে লোককল্যাণ হয় না, হয় লোকসংহার। তাতে আসুরিকতা ও পাশবিকতার জয় হয়। এই পাশবিকতা ও আসুরিকতার সংহার করে, সমাজকল্যাণকর কাজ করতে চাই রজোগুণাত্মক শক্তির সাধনা। তাই দেবী সত্ত্বগুণময়ী হয়ে রজোগুণাত্মক সিংহকে করেছেন বাহন, অর্থাৎ অনুগত আজ্ঞাবহ ভৃত্য।
আরও শুনুন: দুর্গা সপ্তমীর অবস্থান অনুযায়ী ঠিক হয় দেবীর যান, মেলে ভাগ্যের ইঙ্গিতও
এ ছাড়াও পুরাণ ব্যতিরেকে যুক্তিবাদী বাস্তব ধারণা থেকেও যদি বাহনদের দেবদেবীর প্রতীক হিসাবে মনে করা যায়, তা হলেও দেখা যাবে দেবী দুর্গার সঙ্গে সিংহের স্বভাবপ্রকৃতিগত অনেক মিল রয়েছে। দেবী যেমন নিখিল বিশ্বের সম্রাজ্ঞী, সিংহও তেমনি পশু রাজ্যের সম্রাট। একদিকে দেবী মহিষাসুরমর্দিনী, আরেকদিকে সিংহের থাবায় এমন শক্তি যে এক থাবায় মহিষের খুলি মস্তক থেকে ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। বলাই বাহুল্য, সিংহ এক মহাবীর্যবান পশু আর দেবী হলেন সর্বশক্তিধারিণী। তাই উভয়ের শক্তির সামঞ্জস্যের বিচার করেই সিংহকে দেবীর উপযুক্ত বাহন বলে মনে করা যায়।