কালীপূজার সঙ্গে নানা কারণেই জড়িয়ে গিয়েছে ভূত। এমনই সে যোগ, চতুর্দশী তিথিকে পালন করা হয় ভূতচতুর্দশী নামে। কিন্তু কীভাবে তিথির সঙ্গে জড়িয়ে গেল ভূতেরা। আসুন শুনে নেওয়া যাক।
ভূতচতুর্দশী নিয়ে নানা মুনির নানা মত। তবে শুরুটা করা যাক রাজা বলিকে দিয়েই। তিনি তখন স্বর্গ, মর্ত অধিকার করে ব্যাপক ক্ষমতার অধিকারী। আর ক্ষমতার সঙ্গে যা জড়িয়ে থাকে, সেই যথেচ্ছাচারও চলছিল সমানে। সেকালেও, ‘বাবু যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ’ – এই সত্যের ব্যতিক্রম ছিল না। রাজা বলির অনুচররাও সকলকে অস্থির করে তুলেছিলেন। এমনকী দেবতাদের প্রাণও ওষ্ঠাগত।
আরও শুনুন: প্ল্যানচেটের মাধ্যমে আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব? জানেন এর সঠিক পদ্ধতি?
তাঁরা ভগবান বিষ্ণুর শরণ নিলেন। বিষ্ণু তখন বামন অবতারে হাজির হলেন রাজা বলির সামনে। বললেন, রাজা বলির বিপুল দানের কথা শুনেছেন তিনি। তিনি নিজেও তাই আজ দানপ্রার্থী। বলি জানতে চাইলেন, কী দান চান তিনি? বামনরূপী ভগবান বিষ্ণু বললেন, মাত্র তিন পা জমি তিনি প্রার্থনা করছেন। বলি সানন্দে রাজি হলেন। এবার সেই বামন অর্থাৎ ভগবান বিষ্ণু তাঁর দৈব ক্ষমতা দেখাতে শুরু করলেন। এক পায়ে অধিকার করলেন স্বর্গ। আর-এক পায়ে মর্ত। কথা মতো তিন পা জমি দেওয়ার কথা। আরও এক পা ভূমি দেওয়া বাকি। বিষ্ণু বললেন, ‘দেহ দান’। বলির তো আর দেওয়ার মতো কিছুই নেই। তিনি শুনলেন ‘দেহ দান’। সানন্দে তিনি পেতে দিলেন নিজের মাথা। বামন অবতারের নাভি থেকে তখন আর এক পা বেরিয়ে এসে স্পর্শ করল বলির মাথা। আর সেই পদচাপে বলির পাতাল প্রবেশ হল তৎক্ষণাৎ। অনুচরবর্গ সমেত তিনি পৌঁছে গেলেন পাতালে। স্বর্গ, মর্ত সবই যখন গিয়েছে, তখন পাতাল ছাড়া বলির আর থাকার কোনও জায়গা নেই। কিন্তু এও তো সত্যি যে, বলি এই ক্ষমতা লাভ করেছিলেন তাঁর সাধনবলেই। স্বয়ং বিষ্ণু চরণ রেখেছেন তাঁর মাথার উপর। এমন সৌভাগ্য ক-জন ভক্তের হয়। কোনও কোনও মতে, বলি জানতেন, ভগবান বিষ্ণু পরীক্ষা করতে এসেছেন তাঁকে। তবু কৃপা পাওয়ার জন্যই তিনি সব জেনেও আগে কিছু বলেননি। আর বিষ্ণুও বলির এই আনুগত্যে সন্তুষ্ট হলেন। আশীর্বাদ করলেন, একটা দিন তিনি সকল অনুচরদের নিয়ে পাতাল থেকে উঠে আসবেন মর্তে। সেই দিনটাই হল এই চতুর্দশী।
আরও শুনুন: পিয়ানো বাজান, ঘোড়াও চড়েন… কলকাতার পুরনো বাড়িতে এখনও নাকি দেখা মেলে ‘তেনাদের’
আবার এমনও মত আছে যে সমস্ত অশুভ দূর করার জন্য মা-কালী এদিন নেমে আসেন চামুণ্ডারূপী চোদ্দ ভূত নিয়ে। কেউ কেউ বলে থাকেন, পরলোকগত আত্মারাও এ সময় মর্তে আসেন। আর তাই তাঁদের আসা-যাওয়ার পথকে আলোকিত করতে জ্বালানো হয় চোদ্দ বাতি। আসলে, এই সময়টা তন্ত্রমতে সাধনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। কালীপূজার সঙ্গে তন্ত্রমতে সাধনার যে নিবিড় যোগাযোগ, তাই-ই নানা গল্পকথায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সাধকের সাধনার ক্ষণটিকে চিহ্নিত করা আছে বিভিন্ন ভাবে। বাংলার মাটিতে মাতৃসাধনা ও তন্ত্রসাধনা বিশেষ ভাবে বিকাশ লাভ করেছিল। তাই ভূত চতুর্দশী নামে এই তিথির পালন কেবল বাংলাতেই। অন্যত্র ভিন্ন নামে এই তিথি পালনের রেওয়াজ আছে।
অতএব ভূত থাকুক বা না-থাকুক, ভূতচতুর্দশী কিন্তু স্বমহিমাতেই আছে।