মনোবিজ্ঞানের গবেষণা বলছে, পরিচয়ের গোপনীয়তা এক লহমায় অনেকাংশে কমিয়ে দেয় আমাদের মনের নানান বাধানিষেধ। নিজের পরিচয় আড়ালে রেখে এই নামহীন চিঠি পাঠানো বা পাওয়া এসব কি নিছই হুজুগ? রোমাঞ্চ? নাকি পরিচয় লুকিয়ে এমন উড়ো চিঠি পাঠিয়ে, আড়ালে বসে প্রতিক্রিয়া দেখার পেছনে থাকে অবচেতনের অন্য কোনও অন্ধকার? আর পত্রগ্রাহক? কেন এমন উড়োচিঠি পাওয়ার প্রবল বাসনা?
উত্তর সন্ধানে দেবস্মিতা গুপ্ত।
যে-কথা বলা হয়ে ওঠে না কিছুতেই, সে-কথা সহজে বলতে পারে কলম। বাস্তবের তেলচিটে দেওয়াল ডিঙিয়ে দেয় আকাশের খোঁজ। হিংসা আড়াল হয়ে হালকা মেঘের মতোই ভেসে বেড়ায় ভালোবাসা। তাই কথা যা পারে না, চিঠি তা পারে অনায়াসে।
চিঠি আসলে আড়াল। কিন্তু যদি প্রেরক নিজেই চলে যান অন্তরালে? মুচকি হাসির আল বেয়ে গোপন সত্যি এসে পড়ে খোলা হাটে। প্রেরক কিংবা গ্রাহক এ বয়ানের ফাঁক দিয়ে কেবল খুঁজতে চান একে অপরকে। সাম্প্রতিক সময়ে এই চিঠির চলিত নির্মাণ ভেঙে ফেলাই হয়ে উঠল এক ট্রেন্ড। কিন্তু কেন? এ-প্রশ্নের উত্তরে আমাদের ফিরে যেতে হয় মনস্তত্ত্বের গোড়ার বিশ্লেষণে।
চিঠির ইতিহাস ঘাঁটতে বসলে ফিরে যেতে হয় বেশ কয়েক হাজার বছরের আগের সময়ে। ৫০০ খৃস্টপূর্বে পার্সি রানি আটোসার লেখা চিঠিকে বিশ্বের প্রথম হাতে লেখা চিঠি হিসাবে গণ্য করা হয়। সেই থেকে শুরু চিঠির পথচলা। মনের ভাবপ্রকাশের জন্য সাক্ষর মানুষ বেছে নিল চিঠির পথ। তবে চিঠি এখন পুরানো সেই দিনের কথা। সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়া ট্রেন্ডিং আবার ফিরিয়ে এনেছে চিঠির আদানপ্রদান। এক্ষেত্রে চিঠির আদল সেই পুরনো চিঠির মতো হলেও, এই চিঠি ভারচুয়াল। তবে এই খেলার সবচেয়ে বড় চমক লুকানো আছে অন্য জায়গায়। চিঠি হবে বেনামি। মনের কথা বোঝাই একখানা চিঠি মুহূর্তে পৌঁছে যাচ্ছে উদ্দিষ্ট মানুষটির কাছে, এদিকে প্রযুক্তির জারিজুরি দিয়ে এই অ্যাপ যেন জাদুবলে গোপন করে দিচ্ছে পত্রপ্রেরকের পরিচয়। বেনামি চিঠির ট্রেন্ড কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় এই প্রথম নয়। এর আগেও কখনও ‘হাশাপ’, কখনও ‘স্টুলিশ’– এসব অ্যাপ মানুষকে দিয়েছে অদৃশ্য হয়ে থাকা বা ‘অ্যানোনিমিটির’ স্বাদ। কিন্তু নিজের পরিচয় আড়ালে রেখে এই নামহীন চিঠি পাঠানো বা পাওয়া এসব কি নিছই হুজুগ? রোমাঞ্চ? নাকি পরিচয় লুকিয়ে এমন উড়ো চিঠি পাঠিয়ে, আড়ালে বসে প্রতিক্রিয়া দেখার পেছনে থাকে অবচেতনের অন্য কোনও অন্ধকার?
দার্শনিক গ্লোকনের বিখ্যাত ‘রিং অফ জাইজিস’-এর গল্পে আমরা দেখি, জাইজিস নামের এক সাদাসিধা রাখাল একবার একটি জাদু-আংটি হাতে পায়, যা আঙুলে পরলেই সে অদৃশ্য হয়ে যায়। এই জাদু-আংটির সুযোগ নিয়েই জাইজিস প্রথমে রাজ্যের রানিকে প্রলুব্ধ করে, রাজাকে হত্যা করে এবং সবশেষে সমগ্র সাম্রাজ্য দখল করে। এই গল্পের সারমর্মে নিহিত আছে এক গভীর তত্ত্ব; তবে কি ন্যায় থেকে অন্যায়ের মাঝের দুলতে থাকা সাঁকোয় প্রহরী হয়ে চিরকাল দাঁড়িয়ে থাকে আমাদের পরিচয়! সেই প্রহরী যদি একদিন সটান ছুটি নিয়ে নেয়, তাহলেই আমরা সাঁকো পেরিয়ে নির্বিকারে চলে আসি অন্য পারে?
মনোবিজ্ঞানের গবেষণা বলছে, পরিচয়ের গোপনীয়তা এক লহমায় অনেকাংশে কমিয়ে দেয় আমাদের মনের নানান বাধানিষেধ। যেমন ধরে নেওয়া যাক, বহুদিন ধরে কোনও একজনের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে মনে কৌতূহলের বীজ দানা বেঁধেছে। এখন কথা হল, সামনাসামনি তাকে সে-প্রশ্ন করা মোটেই সমীচীন নয়; সোশ্যাল মিডিয়ার পাতায় সেই প্রশ্ন করলে নিজের পরিচয় এসে পড়বে সামনে, উল্টোদিকের মানুষটি নিঃসন্দেহে আপনার এই কৌতূহল ভালোভাবে নেবেন না। এসব ভেবেচিন্তে যখন মনের অদম্য কৌতূহলকে প্রায় প্রশমিত করে ফেলছেন, ঠিক সেই সময় যদি এমন একখানা সুযোগ আপনার হাতে এসে পড়ে, যেখানে আপনি প্রশ্ন করে ফেলতেও পারলেন, আবার কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পেল না প্রশ্নকর্তাটি কে, এমন ‘সাপও মরল লাঠিও ভাঙল না’ গোছের সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়!
পরিচয় বহুমাত্রিক। নাম, ধাম, পদ, পদবী, লিঙ্গ– সবই আমাদের সামগ্রিক পরিচয়ের টুকরো টুকরো অংশ। বহুক্ষেত্রে এগুলির কোনও একটি বা একাধিক আমরা গোপন করতে চাই প্রয়োজনমাফিক। সেখানে এক সুযোগে যখন সবকটি পরিচয়কে পর্দার আড়ালে রেখে নিজের মতামত, আবেগ, প্রস্তাব, অভিমান, ক্ষোভ, আক্রোশ, বিদ্বেষ– যে কোনও কিছুই বলে ফেলা যায়, তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে সেই নদীতে ডুব দিতে বাধা কোথায়?
যেসব কথা, হুমকি বা আক্রমণ সামনাসামনি করা যায় না, তা যে সহজেই উগরে দেওয়া যায় সোশ্যাল মিডিয়ায়, তার বিস্তর প্রমাণ মিলেছে গত এক দশকে। এর প্রধান কারণ হিসেবে যেগুলি উঠে এসেছে তার মধ্যে অন্যতম এই যে, আক্রমণকারী আক্রমণের সময়, যাকে আক্রমণ করা হচ্ছে তার নাগালের বাইরে থাকে। ফলে এই ভারচুয়াল মাধ্যম আক্রমণকারী ও শিকারের মাঝে এক অদৃশ্য শিল্ডের মত কাজ করে। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে এই সব বেনামি বার্তা পাঠানোর মাধ্যমগুলোর ক্ষেত্রে সেই শিল্ড যেন আরও অনেকগুণ মজবুত হয়ে ওঠে নিমেষেই। তবে এমন উড়োচিঠি যে কেবল রাগ, হিংসা, হুমকিই নিয়ে আসছে তা তো নয়; গোবেচারা, চুপচাপ স্বভাবের সদ্য গোঁফের রেখা ফোটা কিশোর, যে কথা শত চেষ্টা করেও, ভয়ের বেড়া ডিঙিয়ে শেষমেশ আর বলে উঠতে পারেনি কোনও এক ‘মাধ্যমিকের বাধ্য মেয়ে’-কে, সেই না-বলা কথাও শিরশিরে নভেম্বরের বিকেলে চিঠি হয়ে পৌঁছে যাচ্ছে মুঠোফোনে। আমাদের প্রতিটা আচরণেই কমবেশি চাপানো থাকে সামাজিক ভার, সামাজিক নির্মাণের প্রত্যাশা। পরিচয়ের গোপনীয়তা সেই ভারকে আলতো করে নামিয়ে দেয় কাঁধ থেকে। ‘মর্দ কো দর্দ নেহি হোতা’ শুনে শুনে বড় হয়ে ওঠা কোনো নরম মনের যুবক, নিজের খুব আবেগঘন কোন এক কৃতজ্ঞতা, বা অভিমানের যে কথা হাসির খোরাক হয়ে যাওয়ার ভয়ে বন্ধুকে বলে উঠতে পারেনি এতকাল, এই অদৃশ্য চাদরে নিজের সামাজিক পরিচয় মুড়ে সেই যুবক বেনামি চিঠিতে দিব্যি লিখে ফেলছে মনের মধ্যে জমিয়ে রাখা সেই কথা।
এ তো গেল প্রেরকের মন। আর পত্রগ্রাহক? কেন এমন উড়োচিঠি পাওয়ার প্রবল বাসনা?
‘যে জন দেয় না দেখা, যায় যে দেখে; ভালোবাসে আড়াল থেকে’-র গভীরে মন মজার চল কিন্তু নতুন নয়। কোনও এক গোপন প্রণয়ীর অস্তিত্ব মানবমনকে চিরকালই আলোড়িত করে, রোমাঞ্চিত করে। এই ছুটতে থাকা জীবনে এমন মানুষের অস্তিত্বকে ঘিরে এই সাময়িক আলোড়ন বা তাকে শনাক্ত করার চেষ্টা হয়ত একরকম অ্যাড্রিনালিন রাশ যোগাচ্ছে তাদের মনে।
তবে শুধুই কি তাই? গল্পের টুইস্ট কিন্তু রাখা মনের আরও গহীন ডেরায়।
মনোবিজ্ঞানীরা দেখছেন, বিগত কিছু বছরে ভারচুয়াল দুনিয়ার উপর নির্ভরশীলতা, সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব মানবমননের অনেক ভিতরের স্তরেও গিয়ে হানা দিয়েছে খুব সন্তর্পণে। মানুষ তার নিজের ‘আমি’-কে খুঁজতে শুরু করছে বাইরের পৃথিবীর কাছে। আর শুধু তো খোঁজ নয়। ‘আমি’ আসলে কে বা কী তা আমি দেখতে চাইছি অন্যের চোখ দিয়ে, এবং সেই ধারণাকে বৈধ সাব্যস্ত করতে আবার ছুটছি অন্য আর-একজনের কাছে। এই নামহীন চিঠির তীব্র আকাঙ্ক্ষা কি তেমনই কোনও বাহ্যিক ভ্যালিডেশনের বহিঃপ্রকাশ?
কিছু ক্ষেত্রে এই ট্রেন্ডে গা ভাসানোর আচরণ হয়তো নেহাতই ‘ফোমো’ বা ফিয়ার অফ মিসিং আউট থেকে বাঁচার পথ। সাম্প্রতিককালে যেসব নতুন শব্দ বা সংক্ষেপণ আমাদের চলতি কথার মধ্যে স্বমহিমায় রাজ করছে, ‘ফোমো’ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এই ফিয়ার অফ মিসিং আউটের অর্থ হল অন্যরা যে উত্তেজক ঘটনায় অংশগ্রহণ করছে, তা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয়। এই বেনামি চিঠি পাওয়ার খেলায় যোগদানের বীজেও হয়তো কখনও কখনও লুকিয়ে থাকছে এমন অজানা ভয়।
ভয়, আনন্দ, উত্তেজনা, রোমাঞ্চ, রাগ এসব অনুভূতির মশলা মিশিয়ে কিংবা নিছকই অবসরের বিনোদন হয়ে নবকলেবরে চিঠি ফিরে এসেছে দিনকয়েকের ট্রেন্ড হয়ে। আর উপরিপাওনা হয়ে জুড়ে বসেছে পরিচয় লুকিয়ে ফেলার এই কানামাছি খেলা।