বাংলার সাম্প্রতিক বন্যাপরিস্থিতিকে ‘ম্যানমেড’ বলে বারবার তোপ দেগেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু বিপর্যয় প্রসঙ্গে এই বিশেষণের উৎপত্তি হল কীভাবে? কে প্রথম ব্যবহার করেন এই শব্দ? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
সাম্প্রতিক কালে যে ভয়াবহ বন্যাপরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে বাংলা, সেই প্রেক্ষিতে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর মুখে বারবারই উঠে এসেছে ‘ম্যানমেড’ শব্দটি। তাঁর অভিযোগ, ডিভিসি ইচ্ছাকৃতভাবে জল ছেড়েছে বলেই এহেন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যা চাইলে আটকানো যেত। অবশ্য এবারই প্রথম নয়, এর আগেও জল থইথই পরিস্থিতিতে ডিভিসি-র দিকে আক্রমণ শানাতে দেখা গিয়েছে মুখ্যমন্ত্রীকে। আবার কেন্দ্র ঘাটাল মাস্টারপ্ল্যান সম্পূর্ণ করছে না বলেও বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয় প্রতি বছর, এই অভিযোগেও বারবার সরব হয়েছে রাজ্য সরকার। অন্যদিকে সাম্প্রতিক কালে ওয়েনাড়ের বন্যা প্রসঙ্গেও রাহুল গান্ধী কেন্দ্রকে কটাক্ষ করে বলেছিলেন, ওই বিপর্যয় ‘ম্যানমেড’।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, প্রাকৃতিক বিপর্যয় প্রসঙ্গে বারবার উঠে আসছে ‘ম্যানমেড’ বিশেষণ। বলা হচ্ছে, কোনও না কোনও ভাবে মানুষেরই হাত রয়েছে ওই বিপর্যয়ের পিছনে। কিন্তু বিপর্যয় ইস্যুতে এই শব্দটি এল কীভাবে? কে-ই বা প্রথম এই শব্দ ব্যবহার করেন?
জানা যাচ্ছে, বিপর্যয়ের সঙ্গে ‘ম্যানমেড’ কথাটি জুড়ে দেওয়ার জন্য কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন ব্যারি এ টার্নার। ১৯৭৮ সালে তাঁর বই ‘ম্যান-মেড ডিজাস্টার’ বইতেই তিনি এই শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেছিলেন। কোনও কোনও বিপর্যয়কে যে প্রকৃতিসৃষ্ট বলে মনে হলেও তা আদতে প্রাকৃতিক নয়, কোনও কোনও বিপর্যয় একান্তভাবেই মনুষ্যসৃষ্ট, সেই বিপর্যয়গুলিকে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের থেকে আলাদা করে চিহ্নিত করতেই এই শব্দবন্ধটি তিনি প্রয়োগ করেছিলেন। বিশেষ করে শিল্প আর কারখানার সুবাদে যে দুর্ঘটনাগুলি ঘটছে, সেগুলিকে ‘ঈশ্বরের খামোখা খেয়াল’ বলে যে উড়িয়ে দেওয়া চলে না, সে কথা প্রথম স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যেসব বই-আলোচনা-তর্কের সূত্র ধরে, টার্নারের বই তার মধ্যে অন্যতম।
কয়েক বছর আগে একটি লেখায় জয়া মিত্র লিখেছিলেন, বন্যা চক্রান্ত নয়, তবে ‘ম্যানমেড’ তো অবশ্যই। কেননা মানুষেরই পরিকল্পিত ও নির্মিত বড়ো বাঁধে পথ রুদ্ধ হয়ে অগভীর হয়েছে নদীখাত৷ প্লাবিত হয়েছে দু’পার৷ তিনি লিখেছিলেন, “তিন-চার বছর পর পর বড়ো বন্যাকে এ দেশের নদীতীরবাসী মানুষরা নিজেদের গ্রামজীবনের, কৃষিকাজের, অন্তর্গত করে নিতে অভ্যস্ত হয়েছিলেন৷ সেই বন্যাজল শুধু যে দু’পাশের প্লাবনভূমি জুড়ে উর্বরা পলিমাটি ছড়িয়ে, পুকুরজলায় অজস্র মাছ ভরে দিয়ে যেত এমন নয়, বাধাহীন তীব্র স্রোতের টানে বন্যাজল নদীখাতকে গভীর করে দিয়ে যেত৷ স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মেই ঘটত এসব, কোনও পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, বাজেট বরাদ্দ ছাড়াই৷” কিন্তু আত্মগর্বে স্ফীত হয়ে ওঠা ধনতান্ত্রিক বিজ্ঞানচিন্তা ‘প্রকৃতিকে জয় করা’র উল্লাসে নদীকে ভেঙে মুচড়ে নিজেদের ‘কাজে লাগানো’র ব্যবস্থা করতে থেকেছে৷ আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করে প্রকৃতিকে পরিবর্তিত করতে গিয়ে অল্প কিছু মানুষ এ কথা ভুলে গিয়েছেন যে এইসব কাজের ফল তাত্ক্ষণিক নয়, বরং সুদূরপ্রসারী হবে৷ বন্যা হওয়ার আগের এই পরিস্থিতি আর পরবর্তীকালের চাপানউতোর দোষারোপ, সবকিছুরই নানা রাজনৈতিক কোণ রয়েছে। তবে এসবের মধ্যে কোথাও না কোথাও যে মানুষের হাতও থেকেই যাচ্ছে, টার্নার সেদিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করাতে চেয়েছিলেন।