মদ মানেই নিষিদ্ধ বস্তু। মদ্যপানকে খুব একটা ভাল চোখেও দেখেন না মানুষ। দেখবেনই বা কেন? মদ্যপান যে স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর, এবং তা কর্কট রোগের কারণ তা তো সকলেরই জানা। অথচ এ দেশেরই এক মন্দিরে প্রসাদ হিসেবে গণ্য হয় মদ। ঈশ্বরকে ভেট হিসেবে চড়ানো হয় হুইস্কি। প্রসাদ হিসেবেও বিতরণ করা হয় সেই কারণসুধাই। কোথায় রয়েছে সেই আশ্চর্য মন্দির? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
দিন কয়েক আগে ‘কালী’ তথ্যচিত্রের পোস্টার বিতর্কে উত্তাল হয়ে উঠেছিল দেশ। সেখানে কালীর সাজে এক মহিলাকে ধূম্রপান করতে দেখা গিয়েছিল। হিন্দু দেবদেবীকে নিয়ে এমন পোস্টার ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করছে বলে অভিযোগ তুলে সরব হয়েছিলেন একটি পক্ষ।
তা মদ বা সিগারেট, কোনও নেশাই যে স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল নয় তা কে না জানে! ভোলামহেশ্বর যে শ্মশানে-মশানে ঘুরে নেশাভাঙ করে বেড়াতেন তা তো সর্বজনবিদিত। আর তার জন্য পার্বতীর তো বটেই, গিরিরাজ ও মেনকার পর্যন্ত অভিযোগের সীমা ছিল না। শুধু কি শিব, সেই তালিকায় রয়েছেন খোদ দুর্গাও। শ্রী শ্রী চণ্ডীর একটি শ্লোকে রয়েছে, “গর্জ গর্জ ক্ষণং মূঢ় মধু যাবৎ পিবাম্যহম। ময়া ত্বয়ি হতেঽত্রৈব গর্জিষ্যন্ত্যাশু দেবতাঃ।” এই বলে মহিষাসুরকে ভর্ৎসনা করেছিলেন দুর্গা। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলে থাকেন, এ মধু যে নেহাতই মধু নয়, তা বোধহয় কারওরই অজানা নয়। সংস্কৃতে ‘মধু’ শব্দের অর্থ আসলে মদ। শাক্ত মতে বহু ক্ষেত্রেই কালীপুজোর এক অন্যতম উপাচার হিসেবে গণ্য হয় এই মদ। এমনকী এদেশেই রয়েছে এমন এক মন্দির, যেখানে প্রধান নৈবেদ্য হিসেবে ঠাকুরের পায়ে উৎসর্গ করা হয় ওই কারণবারিই।
আরও শুনুন: মুখে খাবার তোলেননি টানা ৭৬ বছর! এখনও রহস্যে মোড়া যোগী প্রহ্লাদের কাহিনি
ঠিকই শুনেছেন। এখানে ভক্তরা দলে দলে আসেন মদের বোতল হাতে নিয়েই। এমনকী এই মন্দিরের প্রসাদও হিসেবে বিতরণ করা হয় মদই। এমনটাই রীতি প্রাচীন এই মন্দিরের। মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়নী শহরে রয়েছে এমনই এক আশ্চর্য মন্দির। স্থানীয়রা বলেন কাল ভৈরবের মন্দির। গোটা উজ্জয়িনী শহরের রক্ষাকর্তা এই কাল ভৈরব নাথ। আট ভৈরবের মধ্যে প্রধান ছিলেন এই কালভৈরব। শিপ্রা নদীর তীরে এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাজা ভদ্রসেন। স্কন্দপুরানের অবন্তী খণ্ড থেকে তেমনটাই জানা যায়। এ মন্দির এক সময় বহু তান্ত্রিক, কাপালিক ও অঘোর সাধুদের আড্ডা ছিল। তন্ত্রমতেই আজও এই মন্দিরে পুজোর্চ্চনা চলে।
আরও শুনুন: প্রসাদ চিকেন কিংবা মটন বিরিয়ানি, দেশের কোন মন্দিরে আছে এমন প্রথা?
তবে এই মন্দিরের বিশেষত্ব অন্য জায়গায়। সাধারণত প্রায় সমস্ত মন্দিরের আশেপাশেই পুজো-উপাচারের সামগ্রীর দোকানপত্তর দেখা যায়। ফুল-মালা থেকে প্রসাদ, ধূপ সবই মেলে ওই সব অস্থায়ী দোকানগুলিতে। তবে এই মন্দিরের আশপাশ জুড়ে মিলবে শুধুই মদের দোকান। হবে না-ই বা কেন? কাল ভৈরব যে শুধু ওই প্রসাদেই তুষ্ট হন। নানা আকারের শিশিতে নানা ধরনের মদ, ভক্তেরা পকেট ও প্রার্থনার ওজন বুঝে কিনে নেন সেসব স্থানীয় দোকান থেকে। দেশি মদের পাশাপাশি রয়েছে বিদেশি মদও। হুইস্কি থেকে রাম, সবই মিলবে এসব দোকানে। তবে এই দেবতা নাকি সবচেয়ে বেশি তুষ্ট হন হুইস্কিতেই। তাই আশপাশের দোকানে হুইস্কির বোতলই অপেক্ষাকৃত বেশি। কালভৈরব মন্দিরকে অনেকে তাই হুইস্কি বাবার মন্দিরও বলে থাকেন। পুজোর ডালায় ফুল-ধূপকাঠির সঙ্গে তাই দেওয়া হয় এই মদের বোতলও।
আশ্চর্যের কথা হল, কালভৈরব নাকি ভক্তদের এই নৈবেদ্য গ্রহণও করেন সানন্দে। মন্দিরের পুরোহিত নাকি একটি প্লেটে মদ ঢেলে তা ঈশ্বরের মুখের সামনে ধরেন। অদ্ভুত ভাবে আস্তে আস্তে ফুরিয়ে যেতে থাকে পাত্রের মদ। ভক্তেরা অনেকে এই কাণ্ড নিজের চোখেই প্রত্যক্ষ করেছেন। কোথায় যায় সেই মদ, আজও সেই রহস্যের সমাধান হয়নি। অনেকেই ব্যাপারটি নিয়ে বিস্তর তদন্ত করেছেন, তবে সেই ফয়সলা আজও হয়নি। মদের প্রসাদ, রহস্যের গন্ধ- এ সব কিছু যেন একশো বছরেরও পুরনো এই মন্দির সম্পর্কে মানুষকে আরও কৌতুহলী করে তুলেছে। শুধু উজ্জয়িনীবাসীরাই নয়, কালভৈরবের এই মন্দির দেখতে দূরদূরান্ত থেকে ভিড় জমান অসংখ্য পর্যটক।