পয়লা জানুয়ারি মানেই ঘরের দেওয়াল থেকে পুরনো ক্যালেন্ডারটা নামিয়ে ফেলার পালা। পুরনো ডেস্ক ক্যালেন্ডার সরিয়ে টেবলে এবার থেকে শোভা পাবে নতুন বছরের দিনপঞ্জি। এমনকি পুরনো ডায়েরিও বাতিলের খাতায়। নতুন বছরের দিন গোনা শুরু নতুন ডায়েরিতে, যেখানে নতুন বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত তারিখ মেনে পাতা সাজানো। এতসবের মধ্যে কি আমরা আদৌ ভেবে দেখি, এই দিন গোনার ক্যালেন্ডারের জন্মদিনটা কবে? কীভাবে তৈরি হয়েছিল আজকের ক্যালেন্ডার?
মানুষ যখন থেকে দিন-তারিখের সালতামামি করতে শুরু করল, তখন চাঁদকেই মানদণ্ড ধরেছিল তারা। চাঁদের গতির সাপেক্ষে যে বছর চলত, তাকে বলা হয় চান্দ্রবর্ষ। কিন্তু চান্দ্রবর্ষ নয়, আমাদের এখনকার ক্যালেন্ডার চলে সৌরবর্ষের হিসেবে, অর্থাৎ সূর্যের অবস্থানের হিসেবে বছর গণনা। এই পদ্ধতি এসেছিল প্রাচীন মিশরীয়দের হাত ধরে। কিন্তু সেই বছর গণনার হিসেব কীভাবে লিপিবদ্ধ করা যায়, সেই কায়দাটা তারা আবিষ্কার করেনি। তা আরেক প্রাচীন সভ্যতার অবদান। যাকে আমরা সুমেরীয় সভ্যতা বলে চিনি। সৌরজগৎ সম্পর্কে তাদের জ্ঞানগম্যি ছিল, আর সেই জ্ঞান থেকেই তারা আবিষ্কার করে ফেলে ক্যালেন্ডার।
আরও শুনুন: বৈশাখ নয়, সেকালে বাংলার নববর্ষ শুরু হত অগ্রহায়ণেই
তবে সেই ক্যালেন্ডার একেবারে আজকের মতো ছিল, এ কথা ভাবলে ভুল হবে। আজ আমরা যে ক্যালেন্ডার ব্যবহার করি, সেই ক্যালেন্ডারের গোড়াপত্তন করেছিলেন রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার। ফের আরেক পুরনো সভ্যতার গল্প। আসলে প্রথম রোমান রাজা রোমিউলাস-ই রোমান ক্যালেন্ডারের প্রচলন করেছিলেন। তবে ৩০৪ দিনের এই ক্যালেন্ডার ছিল দশ মাসের, আর বছর শুরু হত মার্চ মাস থেকে। খ্রিস্টপূর্ব ৭০০ সালে রাজা নুমা পম্পিলিয়াস আরও তিনটি মাস যোগ করে বসেন এই ক্যালেন্ডারে। তার মোট সময়সীমা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫৪ দিন। কিন্তু মুশকিল হয়েছিল যে, রাজা বা পুরোহিত বা অভিজাত সম্প্রদায়ের লোকজন অনেকেই ইচ্ছেমতো দিন যোগ করে নিতেন এই ক্যালেন্ডারে। সেই সমস্যা মেটাতে ফের মিশরেরই দ্বারস্থ হন সম্রাট সিজার। আলেকজান্দ্রিয়ার জ্যোতির্বিদ সসিজেনিস-এর পরামর্শে নতুন ক্যালেন্ডার চালু করেন তিনি। জুলিয়াস সিজারের নামানুসারে এই ক্যালেন্ডারকে চিহ্নিত করা হয় জুলিয়ান ক্যালেন্ডার বলে। নিজের নামে একটি মাসেরও নাম রাখেন সম্রাট। সেই জুলিয়াস মাসই আজকের সপ্তম মাস জুলাই। আর তার আগের মাসের নাম অগস্ট রাখেন পরবর্তী রোমান সম্রাট অগাস্টাস। রোমানদের ফটকের দেবতা জানুস। যেহেতু ফটকের দেবতার নামানুসারে জানুয়ারি মাসের নাম, তাই জানুয়ারি মাসকেই নতুন বছরের ফটক বা দরজা হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। তখন থেকেই ১ জানুয়ারি নববর্ষ উদযাপনের শুরু।
আরও শুনুন: ‘সান্তা ক্লজ এক্সপ্রেসে’ চড়ে যাওয়া যায় সান্তার বাড়ি, সে এক আশ্চর্য মুলুক
প্রাচীন মিশরের হিসেবমতো সসিজেনিস ধরে নিয়েছিলেন সূর্যের চারদিকে পৃথিবী একবার আবর্তন করতে সময় নেয় ৩৬৫ দিন ৬ ঘণ্টা। কিন্তু আসলে এই সময়টা গড়ে ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৪৫ সেকেন্ড। মূল সৌর বছরের সাথে জুলিয়ান বছরের পার্থক্য তাই প্রায় ১১ মিনিট ১৫ সেকেন্ডের। ফলে সমস্যা মিটেও মেটেনি। মধ্যযুগের ইউরোপে লোকে জুলিয়ান ক্যালেন্ডারকে পাত্তা না দিয়ে ধর্মীয় তিথি মেনে নতুন বছর পালন করত। শেষকালে পোপ গ্রেগরি দ্য থার্টিন ক্যালেন্ডার সংশোধনের ভার দেন ক্রিস্টোফার ক্ল্যাভিয়াস নামের এক জ্যোতির্বিদকে। তিনিই প্রথম চার বছর অন্তর লিপ ইয়ারের প্রস্তাব দেন। ১ জানুয়ারিকেই বছরের প্রথম দিনের মর্যাদা দেওয়া হয়। ১৫৮২ সাল থেকে চালু হয় এই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার। আর এখনও পর্যন্ত সেই ক্যালেন্ডারই ব্যবহার করে চলেছি আমরা।