বাধ সেধেছে পরিস্থিতি, তাই হুইলচেয়ারে বসে কাটাতে হবে বাকি জীবন। পা নেই তবু থেমে নেই পায়ে পায়ে এগিয়ে চলার স্বপ্ন। তাই হুইলচেয়ারে বসেও নাচের মুদ্রা ছাড়েননি তাঁরা। মঞ্চ মাতাচ্ছেন, প্রশংসা কুড়াচ্ছেন অগুনতি মানুষের। জানেন, তাঁরা কারা? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
কেউ ডাক্তার কেউ বা ইনস্টা-ইনফ্লুয়েন্সার। হাঁটাহাঁটির শক্তি হারিয়েছেন বহু আগেই। জন্মগতভাবে কিংবা দুর্ঘটনার প্রকোপে এমন ভয়ানক বিপর্যয় এসেছে জীবনে। প্রতিটা দিনই কাটে হুইলচেয়ারের উপর বসে। অথচ একফোঁটাও ভাটা পড়েনি তাঁদের ইচ্ছাশক্তিতে। তাই নাচ-ই হয়ে উঠেছে তাঁদের বেঁচে থাকার একান্ত আশ্রয়। মঞ্চে উঠে কিংবা ক্যামেরার সামনে দুরন্ত ভঙ্গিতে নাচেন তাঁরা। আসলে প্রতিবন্ধকতার বীজ যেন শরীরে থাকে না, থাকে মনেই। আর তাই মনের ইচ্ছাটুকু অটুট থাকলে যে কোনও বাধাই যেন অনায়াসে জয় করে নেওয়া যায়। তা প্রমাণ করেই যেন পুলকিত শর্মা কিংবা শর্মিষ্ঠা সিনহারা বহু মানুষের অনুপ্রেরণা।
পুলকিত শর্মা,বয়স ৩৫-এর কোঠায়। জন্ম থেকেই লড়ছেন সেলিব্রাল পালসি নামক রোগে। হাঁটার শক্তি হারিয়েছেন শুরু থেকেই। তারপরে হাঁটুতে অসংখ্য কাটাছেঁড়া তাঁকে পুরোপুরি হুইলচেয়ারে বসিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তাতে কী! সেখানে বসেই তিনি তুখড় ভাংড়া নেচেছেন। অংশগ্রহণ করেছেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। কোভিডের সময় থেকেই তিনি পুরোদস্তুর নেমে পড়েন নেটদুনিয়ায়। খুব কম সময়ের মধ্যেই তাঁর সোশ্যাল মিডিয়ার পেজে ভিড় করেন লক্ষাধিক মানুষ।
শুধু কি তিনি? কখনও না। এই একই পথে পাড়ি দিয়েছেন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আরও অনেকে। তাঁদের বয়স আলাদা। পোশাক-আশাক-রুচি-সংস্কৃতিও আলাদা। শুধু একটিমাত্র সুতোয় তাঁরা গেঁথে আছেন একে অপরের সঙ্গে। আর তা হল মনের জোরে সব বাধাকে টপকে যাওয়ার ইচ্ছা।
ভাংড়ার সাজপোশাকে পাঞ্জাবের একটি দলকে আচমকা দেখলে বোঝা শক্ত যে তাঁরা কোন না কোন ভাবে হারিয়েছেন তাঁদের স্বাভাবিক শরীরটি। আর সেই সমস্ত মানুষগুলিকে নাচের তালে বেঁধেছেন হরিন্দরপাল সিং। ডাক আসে দেশ-বিদেশ থেকে।
বেলজিয়ামের ফ্লোরেন্স ডেডলিসেভার মাত্র ১৭ বছর বয়সে খুইয়েছেন হাঁটার ক্ষমতা। একইরকমভাবে তিনিও হুইলচেয়ারে বসে খুলেছেন নাচের দল। আজ তিনি ৩৭। ক্যালিফোর্নিয়ার চেলসিজ হিলের বয়স এখন ২৫। শৈশবেই হারিয়েছেন পা। তবু মার্কিনি এই যুবতী হারাননি নৃত্যশিল্পী হওয়ার অদম্য ইচ্ছাশক্তি। আরও আছে। শ্রুতি সিং। এলাহাবাদের এই কিশোরী একজন ইনস্টা-ইনফ্লুয়েন্সার। হুইল চেয়ারে বসেও যে নাচা যায়,তার অসামান্য নজির দেখা যায় শ্রুতির ইনস্টাপেজে।
আরও শুনুন: হাত নেই, হাতে কাজের অভাবও নেই! ইচ্ছে থাকলে উপায় হওয়ার পথ বাতলাচ্ছেন এই ব্যক্তি
তবে এতোগুলো নামের ভিড়ে আরও একটি নাম না করলেই নয়। শর্মিষ্ঠা সিনহা। পেশায় ডাক্তার। খোদ কলকাতার বাসিন্দা। আরজি কর-এ ডেমোন্সট্রেটর, ফিজিওলজি বিভাগে তিনি কর্মরত। ছোটবেলা থেকেই ভালোবাসেন নাচতে। দীর্ঘদিন ধরে তালিম নিয়েছেন শাস্ত্রীয় নৃত্যের। কয়েক বছর আগে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিরদাঁড়া। শরীর সম্পূর্ণ পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে পড়ে। হুইলচেয়ারই আশ্রয়। কিন্তু কিছুই আটকাতে পারেনি এই বঙ্গকন্যাকে। একদিকে চিকিৎসা, অন্যদিনে নিজের নাচ। পাশাপাশি বিভিন্ন নাচের প্রতিযোগিতায় বিচারকের ভূমিকা। এককথায় দশভুজা হয়ে তিনি দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন বিশ্ব।
প্রতিবন্ধকতার রকমফের হতে পারে। রকমফের হতে পারে পরিবেশ-পরিস্থিতির। কিন্তু সেসবকে এক তুড়িতে উড়িয়ে দেওয়ার নামই যে জীবন, এই মানুষগুলো তা যেন আবার নতুন করে মনে করিয়ে দিলেন আমাদের। সমাজের উঁচু তলায় থাকা বড় মানুষদের গল্প প্রেরণা জোগায় আমাদের। সেখানেই কিন্তু শেষ নয়। সাধারণের ভিড়ে মিশে থাকা এই অসাধারণ মানুষগুলোই যেন আমাদের রোজকার জীবনের আসল অনুপ্রেরণা।