যিনি রাঁধেন, তাঁর ভোটে দাঁড়ানো মানা? আজকের রাজনীতিতে সে কথা বলা মুশকিল। যে রান্না করা বিষয়টিকে একসময় দুর্বলতার তকমা দেওয়া হত, ভোটের ময়দানে তা-ই কখন হয়ে উঠছে নেতানেত্রীদের ইউএসপি। ভেঙে যাচ্ছে চলতি ধারণার ছকও।
যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে, থুড়ি রাজনীতিও করে। অন্তত এই সময়ে দাঁড়িয়ে যে দুয়ের মধ্যে কোনও বিরোধ নেই, তা বারেবারেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন রাজনীতির দুনিয়ায় থাকা একাধিক নেত্রী। লোকসভা ভোটের আবহেই জনৈক নেতা মহিলা প্রার্থীদের কটাক্ষ করে বলে বসেছিলেন, “ওঁরা তো কেবল রান্নাঘরে খুন্তি নাড়তেই পারেন। জনতার দরবারে এসে কথা বলার সামর্থ্যও ওঁদের নেই।” কিন্তু তাঁরা বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা যেমন এখন আর কেবল রান্নাঘরে আটকে নেই, তেমনই তা আর তাঁদের দুর্বলতাও নয়। বরং, একসময় যে বিষয়টিকে টেনে তাঁদের দুর্বলের তকমা দেওয়া হত, সেই বিষয়টিকেই তাঁরা প্রয়োজন পড়লে বাইরের দুনিয়াতেও ব্যবহার করে ফেলতে পারেন, নিজেদের আরও একটি জোর হিসেবেই।
আরও শুনুন:
যিনি রাঁধেন, তাঁর ভোটে দাঁড়ানো মানা?
এমনিতে বলা হয়ে থাকে, মানুষের হৃদয়ে পৌঁছনোর সেরা রাস্তা নাকি তার পাকস্থলীর মধ্যে দিয়ে। যাঁরা ভালো রাঁধেন, তাঁরা এ কথা হামেশাই বলে থাকেন। হয়তো সে কথা মনে রেখেই, জনসংযোগের আরেকটি হাতিয়ার হিসেবে রান্নাকেও গুরুত্ব দেন অনেকেই। সত্যি বলতে, ভোটের সময় আমজনতার সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে নেতানেত্রীরা কোনও পথই তো বাদ রাখেন না। কেউ বাজার করে দেন তো কেউ আবার সাবান মাখিয়ে দিতেও পিছপা হন না। সেখানে মহিলা ভোটারদের সুখদুঃখের কথা জানতে, তাঁদের সঙ্গে ভাব জমানোর জন্য হেঁশেল অব্দি পৌঁছে গেলে লাভ বই ক্ষতি নেই। অনেক নেত্রীই সে কথা মনে রাখেনও বইকি। বিশেষ করে তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বারেবারেই দেখা গিয়েছে রাজনৈতিক কর্মসূচির সঙ্গে ভারি অনায়াসেই রান্নাকে জুড়ে নিতে। একটি রাজ্যের খোদ মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলালেও, জনতার মুখরিত সখ্য থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেননি তিনি। বাড়ির কালীপুজোতে সবসময়ই তিনি নিজে হাতে ভোগ রাঁধেন নিষ্ঠাভরে, সে কথা তো জানাই। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে উত্তরবঙ্গ সফরে গিয়েও দেখা গিয়েছে, পথের পাশের দোকানে মোমো বানাতে হাত লাগিয়েছেন মমতা। শান্তিনিকেতনের ঝুপড়ি দোকানে লাবড়া রান্নায় যোগ দিতেও তাঁর উৎসাহের অভাব নেই। আবার ঝাড়গ্রাম সফরে আলুর চপ ভেজে, সাধারণ ক্রেতাদের হাতে হাতে চপ তুলে দিতেও দেখা গিয়েছে তাঁকে। না, মহিলা বলেই তাঁর সঙ্গে রান্নার সহজ সমীকরণ জুড়ে দেওয়া যায়নি। বরং সেই চলতি সমীকরণকে মমতা যেভাবে তাঁর রাজনৈতিক হাতিয়ার করে নিয়েছেন, তা রাজনৈতিক নেত্রী হিসেবে তাঁকে বাড়তি ব্রাউনি পয়েন্ট জুগিয়েছে নিঃসন্দেহে।
আরও শুনুন:
মাছ, মাংস, মিষ্টি… স্বাদের আহ্লাদও আসর মাতাচ্ছে ভোট-রাজনীতির
এখানে এই বিষয়টি নজর করার মতোই, যে, রাজনীতির তাগিদে হলেও, কখনও কখনও একইভাবে রান্নাকে হাতিয়ার করছেন পুরুষ রাজনীতিকেরাও। সম্প্রতিই যেমন অমৃতসরের লঙ্গরে গিয়ে রান্নায় হাত লাগিয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এর আগে অবশ্য রান্না করতে দেখা গিয়েছিল রাহুল গান্ধীকেও। তবে রাজনীতির প্রকাশ্য জনসংযোগ করতে নয়। ইন্ডিয়া জোট গড়ার পরে লালুপ্রসাদের বাড়িতে গিয়েই মাটন চম্পারণ রান্নায় নিজের দক্ষতা পরখ করেছিলেন কংগ্রেস নেতা। সেই হেঁশেলনামাকে অবশ্য পরে স্বাদের লড়াইয়ে টেনে এনেছেন মোদিই। রাহুলের মাংস রান্না থেকে তেজস্বীর মাছ খাওয়া, সবকিছুকেই লাগাতার নিশানা করেছেন তিনি। আর এবার নিজের রান্নার দক্ষতাকে হাতিয়ার করেই সেই কটাক্ষের অম্লমধুর জবাব দিয়েছেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মোদি যেমন নিরামিষের পক্ষে সওয়াল করেন, তেমনই মমতার বক্তব্য, কেউ ধোকলা খেতে ভালোবাসে তো কেউ দোসা। কেউ ইডলি তো কেউ পরোটা। কেউ আবার বিরিয়ানি। পটল চিংড়ি, ঝিঙে চিংড়ি, চিংড়ি মালাইকারি, একনিশ্বাসে খাবারের মেনু সাজিয়ে দিয়েছেন মমতা। আর তারপরে তাঁর খোলা নিমন্ত্রণ, মোদি যদি খেতে চান নিজে হাতেই রান্না করে খাওয়াবেন তিনি। আমিষ-নিরামিষ দ্বন্দ্বে বারবার শান দিয়ে সংস্কৃতি বা ধর্মের যে রাজনীতি উসকে দিচ্ছেন মোদি, তার বিরোধিতায় মমতার এই মন্তব্য কিন্তু লা-জবাব, এমনটাই মনে করছে রাজনৈতিক মহল। এ দেশ যে বহুমাত্রিকতার কথা বলে, বহু ধরনের খাদ্যও সেই মিশ্র সংস্কৃতিরই অংশ বইকি! সেই স্বাদের অধিকারটুকু জারি রাখার পক্ষেই সওয়াল করুক রাজনীতি, কেননা স্বাদের ভিন্নতাও আদতে ভিন্নমতেরই অংশ। রান্নাকে হাতিয়ার করেই সে কথা মনে করিয়ে দিলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী।