যে দেশে মসজিদ ভেঙে মন্দির তৈরি হয়ে গেল আইন মেনেই, সেই দেশের উদ্দেশেই গান্ধী বলে গিয়েছিলেন, “হিন্দু তাহাদের ধর্ম অথবা মন্দির রক্ষা করিতে অপারগ হইয়া যদি মসজিদ ধ্বংস করে, তাহা হইলে সে ইহাই প্রমাণ করবে যে, মন্দিরধ্বংসকারী মুসলমানের মতোই সেও ধর্মান্ধ।” তাঁর রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন চলতে পারে, কিন্তু সে রাজনীতিকে খতিয়ে না দেখে উপায় নেই।
ভারতবর্ষের রাজনীতি তাঁকে ছাড়া অসম্পূর্ণ। সেদিনও, এদিনও। কেননা গান্ধীজি একজন ব্যক্তি মাত্র নন, তিনি সমগ্র জীবন দিয়ে নির্মিত এক আদর্শ। নিজের জীবনকে নিজের বাণী করে তুলতে গেলে, একজন ব্যক্তিকে, ব্যক্তির ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে যেতে হয়। সেটাই ছিল গান্ধীজির আজীবনের অনুশীলন। এমন নয় যে, তাঁর সব সিদ্ধান্তই সঠিক। বিশেষত জাতীয় আন্দোলন গড়ে ওঠার সময়পর্বে একে একে উঠে আসা গণ-অভ্যুত্থান এবং গান্ধীর ভূমিকা- চিরকালই ইতিহাসের আতশকাচের তলায় থেকেছে। তাঁর রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে একমত হননি অনেকেই। তাঁদের মধ্যে আছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও। তা সত্ত্বেও, গান্ধীকে ছাড়া ভারতবর্ষের রাজনীতির গতিপথ প্রায় রুদ্ধ হয়ে যায়। ইউরোপের সংস্রবে আসা ভারতবর্ষ আর প্রাচীন ভারতবর্ষের ভিতরকার যে দ্বন্দ্ব, তা অতিক্রম করে একটা নির্দিষ্ট গন্তব্যের অভিমুখী দেশ গড়ে তোলার জটিল কাজটি নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন তিনি।
-: আরও শুনুন :-
রবীন্দ্রনাথ যদি ভোটে দাঁড়াতেন, কী থাকত নির্বাচনী ইস্তাহারে?
রবীন্দ্রনাথের ভরসা ছিল আত্মশক্তিতে, গান্ধীর আশ্রয় ছিল অহিংসায়। এ বিষয়ে মতামত স্পষ্ট করে দিয়েই তিনি জানিয়েছিলেন, “অহিংসার আদর্শ হইল শত্রুকেও ভালবাসিতে হইবে। অথচ তাহার অত্যাচারের যন্ত্রটিকে ভাঙিয়া দিতে হইবে। তোমরা মনে মনে শত্রুর প্রতি প্রেম অক্ষুণ্ণ রাখিতে চেষ্টা করিও। কিন্তু যদি না পার, অন্তত তাহাকে ঘৃণা করিও না। তেমনি অহিংসা মনের মনের মধ্যে বজায় রাখিতে পারলেই কাজ হইয়া যাইবে।” গান্ধী জানতেন এমন একটা দেশের জননায়কের ভূমিকায় তিনি অভিষিক্ত, যেখানে মানুষের কাছে ন্যূনতম শিক্ষাও নেই। তিনি যখন বক্তৃতা দিতে যান, তখন তাঁর ভূমিকা হয়ে যায় অবতারের। জনৈকা বৃদ্ধা জানিয়েছিলেন, বাড়িতে গোপাল আছে; আর গান্ধীদর্শন হয়ে গেল, অতএব আর পুনর্জন্মের ভাবনা থাকল না। এই বাস্তবতা তাঁর অজানা নয়। বরং এখান থেকেই আধুনিক ভারতের আকাশ দেখতে চাইছিলেন তিনি। পাশাপাশি, শুধু ইংরেজ শাসন নয়, ভারতবর্ষের মানুষের ভিতর ভিতর যে নিহিত যে ‘পাপ’, তা দূর করার ভাবনাও তাঁকে ভাবিয়েছে। জাত-পাতের দরুন যে তীব্র ছোঁয়াছুঁয়ির অসুখ, তা থেকেও মুক্তি চাই। এই বিবিধ সমস্যার সমন্বয়ের পথ খুঁজতে খুঁজতে চলেছেন গান্ধী। বাহুল্যবর্জিত জীবন, কৃচ্ছ্রসাধন, হাতের কাজে দেশের মানুষকে এক আদর্শে বাঁধতে চাইছিলেন কখনও। কখনও আবার চরকার চাকায় হাত রাখার মধ্যেও যে দেশের প্রত্যেকের ভূমিকা থাকতে পারে, এমন একটা ভাবনা ছড়িয়ে দিতে চাইছিলেন। মতে-পথে-গোঁড়ামিতে বিভক্ত দেশকে তিনি একসূত্রে আন্দোলিত করতে চাইছিলেন। দেশের যে অবস্থায় গান্ধী সর্বাধিনায়কের আসন নিয়েছিলেন, সেখানে তাঁর পথ বরাবরই দ্বিধা ও সংশয়ে আচ্ছন্ন থেকেছে। তাঁর সিদ্ধান্ত প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। স্বদেশচেতনার নিরিখে মতবিরোধের জায়গা তৈরি হয়েছে। তবে যে জায়গাটায় তিনি দ্বিধাহীন, তা হল সত্য এবং কর্ম। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর যে মতবিরোধই থাক না কেন, এই দুই জায়গায় দু’জনেই এক বিন্দুতে। তাঁদের কর্মের প্রকৃতির রকমফের থাকতে পারে, তবে কর্মের মধ্য দিয়েই যে দেশ ও দশের মুক্তি এ ব্যাপারে দু’জনেই প্রায় নিঃসংশয় ছিলেন। বহু বিষয় নিয়েই গান্ধীকে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। তবে, দেশের দারিদ্র্য অনাহার থেকে যে মুক্তি দরকার, তা তিনি কখনও ভোলেননি। যে পাখি গান গায়, সে তো দিনের খাবারটা খেতে পায়। অথচ লক্ষ লক্ষ মানুষ যে খাদ্যাভাবে অনাহারে ক্লান্ত ডানা মুড়ে ফেলে, তাদের উড়ান কীভাবে সম্ভব? আত্মশক্তিই হোক আর অহিংসার জোরই হোক, এই নিরন্ন বা প্রায় অন্নহীন মানুষের বেঁচে থাকার প্রাথমিক ক্ষমতা থাকা জরুরি। যে ক্ষমতা আরও বৃহত্তর অর্থে প্রসারিত হতে পারে। এই ভাবনা গান্ধীকে আজীবন ভাবিয়েছে। নৈতিক ও মতবাদের বহু দ্বন্দ্বের শেষে তাই তাঁর একটাই কথা- ‘A drowining man cannot save others. In order to be fit to save others, we must try to save ourselves. Indian Nationalism is not exclusive, nor aggressive, nor destructive. It is health giving, religious, and therefore humanitarian. India must learn to live before she can aspire to die for humanity.’ অর্থাৎ গান্ধীর স্পষ্ট কথা, মানুষ বাঁচলে তবে তো মানবতা। বিড়ালের ধারাল দাঁতে আটকে পড়া ইঁদুর নিশ্চিত আত্মত্যাগের গৌরব অনুভব করে না।
-: আরও শুনুন :-
অভ্রান্ত নন, অবতারও নন… তবু গান্ধীকে অস্বীকারে ক্ষতি ভারতেরই
আর একটি জিনিস বরাবর চেয়েছেন গান্ধী, তা হল শুদ্ধতা। প্রথমত, আত্মিক শুদ্ধতা। যার অনুশীলন শুরু ব্যক্তিগত স্তরে। তাই-ই আসলে সামাজিক শুদ্ধতার পরিসর গড়ে তোলে। তখনই ধর্মের তাৎপর্য বোঝা যায়। যে দেশে মসজিদ ভেঙে মন্দির তৈরি হয়ে গেল আইন মেনেই, সেই দেশের উদ্দেশেই গান্ধী বলে গিয়েছিলেন, “এমনকী যদি বহু মন্দির ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়, তবুও আমি মসজিদ স্পর্শ করিব না। এবং এইভাবে আমি তথাকথিত ধর্মান্ধ ব্যক্তির সম্মুখে আমার ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করিব। … নিজের ধর্ম ও মন্দির রক্ষার জন্য হিন্দু যেন অপরের মসজিদ ধ্বংস না করে, বা অপরের প্রাণনাশ না করে। মন্দির ও দেবতাকে রক্ষার কাজে রত থাকা অবস্থায় কেমন করিয়া মৃত্যুবরণ করিতে হয়, তাহা সে শিখুক। কিন্তু হিন্দু তাহাদের ধর্ম অথবা মন্দির রক্ষা করিতে অপারগ হইয়া যদি মসজিদ ধ্বংস করে, তাহা হইলে সে ইহাই প্রমাণ করবে যে, মন্দিরধ্বংসকারী মুসলমানের মতোই সেও ধর্মান্ধ।” মুসলমানদের উদ্দেশে বলেছিলেন, “হিন্দুরা যদি উন্মত্ত হইয়া মসজিদ ধ্বংস করে- তাহা হইলে হিন্দুদের মন্দির ধ্বংস করিতেই হইবে, ইহা কোন ধরনের কথা? ইহাও সেই প্রতিশোধ এবং প্রতিহিংসার কথা।” এ-সব কথাই যেন ইতিহাসের আয়রনিতে তলিয়ে গিয়েছে। তবু ভুললে চলবে না, এই শুদ্ধতার পথ ধরেই রাজনীতির অন্য দিগন্তেও পৌঁছতে চেয়েছিলেন গান্ধী। বাঁচতে চাওয়া, স্বাধীনতা চাওয়া, এই সবকিছুর জন্য চাই ক্ষমতা। অতএব চাই আন্দোলন। তার জন্য চাই সংগঠন। আবার ক্ষমতা যখন কেন্দ্রীভূত হয়ে ওঠে তখনই তা মানুষকে ভুল পথে চালিত করে। ভ্রষ্টাচার ডেকে আনে আত্মার অশুদ্ধি। যে মোকাম থেকে শুরু হয়েছিল সেখান থেকে সরে যেতে হয় অনেক দূরে। তাহলে এই সংগঠনের কী দরকার! উদ্দেশ্যে পৌঁছে গেলে তাই সংগঠন ভেঙে দেওয়াই বিধেয় বলে মনে করেছেন। এই গড়া-ভাঙার ভিতর অশুদ্ধির শ্যাওলা জমে না বলেই ছিল তাঁর বিশ্বাস।
অর্থাৎ নতুন এক অনুশীলনে গান্ধীজীর প্রত্যাশা ছিল রাজনৈতিক শুদ্ধতায় পৌঁছনো। তাঁর জীবন তাঁর বাণী হলে, এই-ই হয়তো থাকত তাঁর নির্বাচনী ইস্তাহারে। আজকের ভারতবর্ষে দাঁড়িয়ে তা শুধু অলীক নয়, প্রহসন বলেই মনে হয়।