মুসলিম শাসনই পিছিয়ে দিয়েছে ভারতকে, এই দাবিতে মাঝে মাঝেই উসকে ওঠে বিতর্ক। মুসলিম বা ব্রিটিশ আমলে নয়, হিন্দু রাজাদের সময়েই কি বেশি ধনী ছিল দেশ? সেকালের অর্থনৈতিক প্রেক্ষিত বিচার করে কী জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
তেরো শতকে আচমকা হানা দিয়ে বাংলা দখল করেছিল তুর্কি বাহিনী। এর আগে ভারতের একেকটি রাজ্য শাসন করে চলেছিলেন হিন্দু বা বৌদ্ধ রাজারা। কোনও কোনও অঞ্চলে প্রভাব ছিল জৈন ধর্মের। কিন্তু এক শাসকের অধীনে প্রায় গোটা দেশের চলে আসা, এই ব্যাপারের শুরু হয় মুসলিমদের হাত ধরেই। তারপর একটা দীর্ঘ সময় ধরে মুসলিম শাসন চলেছে এ দেশে। মামুদ বা চেঙ্গিজ খাঁ-র মতো কেউ কেউ লুঠপাট চালাতে এসেছেন বটে, কিন্তু তুর্কি থেকে খলজি থেকে মুঘল- সব মুসলিম শাসকেরাই এ দেশে পাকাপাকিভাবে থেকে গিয়েছেন। তবে এতদিন পরেও মুসলিমদের নাম থেকে বহিরাগত তকমা পুরোপুরি মুছে যায়নি। বরং সাম্প্রতিক কালে মাঝে মাঝেই উসকে উঠেছে সেই বিতর্ক। হিন্দু রাজাদের শাসনে দেশের যা পরিস্থিতি ছিল, তার ঘোর অবনতি হয়েছে মুসলিম শাসনে এসে, এই দাবিতে সরব হয়েছেন হিন্দুত্ববাদীরা। এবার সে সময়ের অর্থনৈতিক লাভ ক্ষতি বিচার করে এই দাবিটিই খতিয়ে দেখলেন গবেষকেরা। কী বলেছেন তাঁরা?
আরও শুনুন: ভারতে যারা জন্মায় তারা সবাই হিন্দু, গুলাম নবি আজাদের দাবিতে শোরগোল নেটদুনিয়ায়
গবেষক স্বামীনাথন আইয়ারের মতে, হিন্দু আমল থেকে মুসলিম আমলে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি হয়নি, বরং উন্নতিই হয়েছিল। তবে দেশ আর্থিক উন্নতির চূড়ায় পৌঁছয় ব্রিটিশ আমলে। আর স্বাধীনতার পর থেকেই তার অবনমন শুরু, এমনটাই দাবি করছেন তিনি। সে দাবির সপক্ষে তিনি ওই সময়গুলি ধরে ধরে দেশের জিডিপি এবং পার ক্যাপিটা ইনকাম-ও দাখিল করেছেন। যেখানে বলা হচ্ছে, ১ থেকে ১০০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতের জিডিপি ছিল প্রায় ৩৪ কোটি ডলার। মুসলিম আমলে, ১০০০ থেকে ১৭০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তা বেড়ে হয় ৯০ কোটি ডলারের বেশি। আর ব্রিটিশ আমলে তা পৌঁছয় প্রায় ২২২ কোটি ডলারে।
আরও শুনুন: লালকেল্লায় প্রধানমন্ত্রীকে জাতীয় পতাকা উত্তোলনে সাহায্য দুই নারীর, কারা তাঁরা?
কিন্তু এই দাবির বিরোধিতা করে স্বামীনাথন ভেঙ্কটরামন বলছেন, যেহেতু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মূল্যবৃদ্ধি ঘটে, ফলে একটি সময়ের আর্থিক অবস্থার নিরিখে আরেক সময়ের অর্থনীতিকে বিচার করা যায় না। তা দেখতে হয় সমকালে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতির তুল্যমূল্য বিচার করে। সেই প্রেক্ষিতে তাঁর দাবি, হিন্দু আমলে ভারতের পার ক্যাপিটা ইনকামের অঙ্ক কম ছিল আপাতভাবে। কিন্তু সেই সময় ভারত কেবল সোনার বিনিময়ে লেনদেন করত। ৭৭ খ্রিস্টাব্দেই তাই রোমান ঐতিহাসিক প্লিনি ভারতকে ‘বিশ্বের সোনার পুকুর’ বলে চিহ্নিত করছেন। পাশাপাশি এই আমলেই চোল বংশের অপূর্ব স্থাপত্যগুলি গড়ে ওঠে, তক্ষশীলা, বিক্রমশীলা, নালন্দার মতো বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। অর্থনীতির সঙ্গে এই সংস্কৃতিরও ওতপ্রোত যোগ আছে বলেই মনে করছেন তিনি। তবে মুসলিম আমলেও দেশের আর্থিক অবস্থার বিরাট অবনতি হয়েছিল, এমনটা কিন্তু তিনি বলছেন না। কারণ মুসলিম আমলে দরবারের জাঁকজমক, তাজমহলের মতো চোখধাঁধানো স্থাপত্য, এগুলি উলটো সাক্ষ্যই দেয়। তবে তাঁর মতে, সেই সম্পত্তি রাজা ও অভিজাতদের নাগালেই ছিল, আমজনতার হাতে আসেনি। ফলে গোটা দেশের অর্থনীতি যে মুসলিম শাসনে হিন্দু আমলের চেয়ে বেশি ধনী হয়ে উঠেছিল, এই কথার বিরোধিতাই করছেন কোনও কোনও গবেষক।