স্তন ক্যানসার! একটা নির্দিষ্ট বয়স পেরিয়ে গেলে প্রায় প্রত্যেক মহিলারই এই নিয়ে সচেতন হওয়া উচিত। তবে, তা পরীক্ষা করে দেখাও বেশ ঝক্কির। সাধারণ ভাবে চোখে দেখে অনেকেই অসুখটা বুঝে উঠতে পারেন না। অথচ চোখের আলো যাঁর নেই, তিনি কিন্তু তা বুঝতে পারেন এক লহমাতেই। দৃষ্টিহীন এক তরুণীর উপরই তাই ভার পড়েছে স্তন ক্যানসার চিহ্নিত করার। কীভাবে এই কাজ করছেন তিনি? আসুন শুনে নিই।
“In the end, we all become stories” – লিখেছিলেন কানাডার বিখ্যাত কবি-ঔপন্যাসিক মার্গারেট অ্যাটউড। অর্থাৎ দিনশেষে আমরা সবাই একেকটা গল্প। যে গল্পে সবচেয়ে বেশি ওঠা-পড়া, চড়াই-উতরাই পেরোনো আছে, সবচেয়ে বেশি মনে থেকে যায় বোধহয় সেগুলোই। এই গল্পটাও তাই শুনে দেখতে পারেন; তা কতটা মনে রাখার মতো, সেটা নাহয় গল্পের শেষেই জানতে চাইব।
আরও শুনুন: চুম্বনে বিভ্রাট! শীতের হাওয়ায় ঠোঁটে টান, সামলাবেন কী উপায়ে?
গল্পটা পাঞ্জাবের লুধিয়ানার নিশা সিং-য়ের। মাত্র ৪ বছর বয়সেই হারিয়ে যায় চোখের আলো। শুধু তাই নয়, খুব কম বয়সেই নিশা, বাবা-মাকেও হারান। উপরন্তু ছোট বোনের দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁরই কাঁধে। এখন উপায়? রোজগার যে তাঁকে করতেই হবে। শুধু নিজের জন্য নয়, বোনের জন্যও। না, দৃষ্টিশক্তি খুইয়ে ভেঙে পড়েননি নিশা। ব্রেলের মাধ্যমে পড়াশোনা শিখে, নিজের মতো, আরও অনেক, ক্ষীণ বা দৃষ্টিশক্তিহীন বাচ্চাদের শিক্ষিত করার কাজে ব্রতী হন। এই পর্যন্ত এসেও যাঁরা গল্পে তেমন ওঠা-পড়া বুঝতে পারছেন না, তাঁদের বলব গল্প এখনও অনেক বাকি। জীবনের হাজার ঝড়ঝঞ্ঝা আমরা সয়ে যেতে পারি, সেটা একরকম। আর এগিয়ে যাওয়ার জন্য লাগে একটা পিছুটান। কখনও কখনও এই দুটো কারণ আলাদা হয়। নিশার ক্ষেত্রে এই দুটো বোধহয় একজনই।
বোনকে পড়াশুনা শিখিয়ে মানুষ করবেন, বোনের সঙ্গে একসঙ্গে থাকবেন কোথাও, নিশার দৃষ্টিহীন চোখ এমন স্বপ্নই দেখত। এদিকে তাঁর উপার্জন যে যথেষ্ট নয়। তাই বাড়তি রোজগারের আশায়, ২২ বছরের নিশা, একদিন লুধিয়ানা থেকে চলে এলেন দিল্লিতে। রাজধানী শহর। কোনও একটা কাজ জুটিয়ে নিতে পারবে ঠিক, ভেবেছিলেন নিশা। যাঁর বোন তখনও লুধিয়ানার এক হোমের বাসিন্দা।
আরও শুনুন: খাবার দেখলেই নাকি মৃত্যুভয়! আজব সব ‘ফোবিয়া’-র কথা জানেন?
ব্রেইল জানার কারণে, দিল্লির NAB India Centre for Blind Women & Disability Studies-এর সঙ্গে যুক্ত হতে কোনও সমস্যা হল না নিশার। এই সংস্থার মাধ্যমেই, এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পরিচালিত, দৃষ্টিশক্তিহীন বিশেষ মেডিক্যাল পরীক্ষকদের একটি ট্রেনিং সেশনে যুক্ত হন নিশা। আর নিশার গল্পের মোড় ঘুরতে থাকে ক্রমশ। নিশা শিখে ফেলেন, কোনোরকম যন্ত্র বা রেডিয়েশন ছাড়া স্তন ক্যানসার নির্ণয়ের কৌশল। শুধুমাত্র স্পর্শের মাধ্যমে, স্তনকে চারটি জোন বা অংশে ভাগ করে ডেকোস্ট্রিপের সাহায্যে কীভাবে প্রাথমিকভাবে নির্ভুল স্তন ক্যান্সার নির্ধারণ করা যায় তা রপ্ত করেন নিশা। এই ডেকোস্ট্রিপ হল, এক বিশেষ ধরনের টেপ, যাতে ব্রেইল পদ্ধতিতে মার্ক করা থাকে। সাদা চোখে দেখার জন্য এতে লাল, কালো এবং সাদা দিয়েও মার্ক করা থাকে। ৮ মাস প্রশিক্ষণের পরই, নিশা পাঞ্জাবি বাগের সিকে বিড়লা হাসপাতালের অঙ্কোলজি বিভাগে যোগ দেন। ব্রেস্ট ক্যানসারের প্রাথমিক পরীক্ষক হিসেবে। ৯টা-৫টার সাদামাটা রুটিন, কিন্তু কাজটা তো সেই অর্থে অসাধারণ।
এটা শুধু লুধিয়ানার নিশার নয়, তাঁর মতো আরও ১৮ জনের জীবনের গল্প। যারা চোখে পরিষ্কার দেখতে পান না। আর দেখতে পান না বলেই, তাঁদের সামনে নিজেদের গোপনাঙ্গ অনাবৃত করতে কোনোরকম লজ্জা বা ইতস্তত বোধ করেন না রোগীরা। কারও যদি পঞ্চেন্দ্রিয়ের কোনোটি অকেজো হয় বা দুর্বল হয় তবে তাঁর অপর ইন্দ্রিয়গুলি খুবই প্রখর হয়। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, এই দৃষ্টিহীন বিশেষ মেডিক্যাল পরীক্ষকদের প্রাথমিক পরীক্ষা একেবারেই নির্ভুল। অঙ্গহানি বা কোনও ইন্দ্রিয় অকেজো হয়ে যাওয়ার পরও অনেকেই সাহস সঞ্চয় করে উঠে দাঁড়ান, কিন্তু নিশার গল্প যেন তাঁদের কাছেও মাইলফলক ।