অন্তঃসত্ত্বা বোঝাতে ‘প্রেগন্যান্ট ওম্যান’ কথাটিই ব্যবহার করা হয় সবসময়। ‘ওম্যান’ অর্থে নারী। কিন্তু সেই শব্দটি ব্যবহার করতেই এবার আপত্তি জানাল খোদ শীর্ষ আদালত। কিন্তু কোন যুক্তিতে? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
অন্তঃসত্ত্বা শব্দের পরেই অনিবার্যভাবে জুড়ে যায় মহিলা শব্দটি। কিন্তু সেই অনিবার্য ধরে নেওয়াতেই এবার বাদ সাধল সুপ্রিম কোর্ট। এক্ষেত্রে কোনোরকম লিঙ্গবাচক শব্দ ব্যবহার করাতেই আপত্তি জানিয়েছে শীর্ষ আদালত। ‘প্রেগন্যান্ট ওম্যান’ নয়, পরিবর্তে ‘প্রেগন্যান্ট পার্সন’ শব্দটি ব্যবহার করার পক্ষেই সওয়াল আদালতের। কোনও মহিলাই কি কেবল অন্তঃসত্ত্বা হতে পারেন? প্রশ্ন আদালতের।
আরও শুনুন:
বিয়েতে আপত্তি নেই, কিন্তু শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে থাকতে কেন নারাজ এ যুগের তরুণীরা?
এ কথা শুনলে আপাতভাবে চমক লাগারই কথা। কারণ এমনিতে চলতি ধারণায় অন্তঃসত্ত্বা বললে মহিলার ছবিই মনে আসবে। জিনগতভাবে যে শিশু নারী হয়ে জন্মাচ্ছে, তার শরীরে প্রাকৃতিকভাবেই জরায়ু ও ডিম্বনালি থাকে। থাকে ফিমেল হরমোনও। নির্দিষ্ট সময়ে তার ঋতু আসে, এবং তারপর খুলে যায় তার মাতৃত্বের সম্ভাবনাও। এই সমস্ত প্রাকৃতিক অনিবার্যতার কারণেই অন্তঃসত্ত্বার সঙ্গে নারী শব্দের যোগ। সেখানে সুপ্রিম কোর্টের এই প্রশ্নের যাথার্থ্য কোথায়? এখানেই খতিয়ে দেখতে গেলে বোঝা যাচ্ছে, সুপ্রিম কোর্টের এই বক্তব্য আসলে নানাদিক থেকেই তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমত, নারী বা ‘ওম্যান’ শব্দের মধ্যে শরীরে-মনে পরিণতি পাওয়ার ইঙ্গিতও রয়েছে। বালিকা বা কিশোরীর পর্যায় পেরিয়ে নারীত্বের শুরু, এমনটা মনে করা যায়। কিন্তু কেউ সেই পরিণত নারীত্বে না পৌঁছলেও, নারীবাচক শারীরিক বৈশিষ্ট্যের দরুন সে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়তে পারে। সত্যি বলতে, আদালত যে মামলায় এই পর্যবেক্ষণ করেছে, সেখানে একটি ১৪ বছরের বালিকা যৌন হেনস্তার কারণেই অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। শারীরিক মানসিক পরিণতির দিক দিয়ে সে কিন্তু এখনও ‘গার্ল’ বা বালিকাই, ‘ওম্যান’-এর শ্রেণিতে তাকে ধরা যাবে না। কিন্তু ‘পার্সন’-এর বড় পরিসরে তাকেও অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া চলে।
দ্বিতীয় কথা হল, কোনও নারী লিঙ্গপরিচয়ে নারীত্বকে ধারণ করলেও, তিনি নিজেকে কেবল পুরুষ-নারীর বাইনারিতে বাঁধতে না চাইতে পারেন। ইংরেজিতে কিন্তু আজকাল অনেকসময়েই ‘হি’ বা ‘শি’ সর্বনামের বদলে ‘দে’ সর্বনামটি ব্যবহৃত হচ্ছে এই কারণেই। আবার কোনও মানুষ জন্মসূত্রে হয়তো নারী, কিন্তু তিনি অন্তরে পুরুষ। এদিকে শারীরিক বৈশিষ্ট্যের কারণে তিনি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছেন, সেক্ষেত্রে তাঁকে কী বলা হবে? উলটো দিকে, কেউ পুরুষের শারীরিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মালেও, তিনি যদি অন্তরে নারী হন এবং লিঙ্গ পরিবর্তনের পথে হাঁটেন, তাঁর নিজেকে অন্তঃসত্ত্বা বলার পথ খোলা রাখতে চায় আদালত।
আরও শুনুন:
বাবার পদবি ব্যবহার করতে লাগবে স্বামীর অনুমতি! এ দেশের মেয়েদের বড় হতে নেই?
সাম্প্রতিক সময়ে লিঙ্গবৈষম্য নিয়ে আস্তে আস্তে সচেতন হচ্ছি আমরা। এ কথাও বুঝতে পারছি যে, কেবল সামাজিক পরিসরে নয়, ভাষার মধ্যেও লিঙ্গবিভাজন মাথা উঁচিয়ে থাকে। যা একেকটি শব্দকে কেবল একটিমাত্র নির্দিষ্ট লিঙ্গের কুক্ষিগত করে দেয়। ফলে অন্য কেউ সে ভাবনায় বা সে কাজে জড়িয়ে যায় হয়তো, কিন্তু সচেতনে সে কাজের অধিকার পেতে হলে তাকে খানিক বাড়তি লড়াইয়ে জড়াতে হয়। অথচ সেই অহেতুক লড়াইয়ের প্রয়োজনই পড়ে না, যদি শব্দের মধ্যে এই বৈষম্য না থাকে। যেমন ধরা যাক, সাম্প্রতিক অতীতেই ব্যাটসম্যান শব্দের বদলে ব্যাটার শব্দ চিনেছে ক্রিকেটদুনিয়া। একসময় যে এই খেলা কেবল পুরুষরাই খেলতে পারতেন, মেয়েদের সেখানে প্রবেশাধিকার ছিল না, শব্দপ্রয়োগই সে কথা বুঝিয়ে দিচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মেয়েরা সে দুনিয়ায় এসে পড়েছেন, ক্রিকেট খেলছেন, তবুও সে পরিভাষা জারি ছিলই। শেষ পর্যন্ত সচেতন প্রতিবাদেই ওই শব্দ সরিয়ে আমদানি করা হয়েছে লিঙ্গনিরপেক্ষ শব্দের। এইভাবেই ক্রমশ যাবতীয় ব্যবহারিক কথাবার্তায় লিঙ্গবাচক শব্দকে সরিয়ে রাখার চেষ্টা হচ্ছে, বদলে এমন শব্দ ব্যবহার করার কথা ভাবা হচ্ছে যেখানে কোনও একটি বিশেষ লিঙ্গের প্রাধান্য নেই। সেই প্রবণতাকেই আসলে মান্যতা দিল দেশের শীর্ষ আদালত। ‘অন্তঃসত্ত্বা’ শব্দের সঙ্গে নারীর এমন অঙ্গাঙ্গি যোগ যে সেখানে এ ধারণা সহজে আসারই কথা নয়। সেখানে সুপ্রিম কোর্টের এহেন বড় পদক্ষেপ আসলে নারীদের জন্যও, এবং সবরকম ‘অপর’ শ্রেণির জন্যও, ভাবনার আকাশটাকে বড় করে দিল অনেকটাই।