৪০০ একর বনজমি উপড়ে দিয়ে বাস্তবায়িত করা হবে আধুনিক ব্যবস্থাপনা সম্বলিত একগুচ্ছ প্রকল্প। বাধ সাধল ইউনিভার্সিটি অফ হায়দরাবাদ-এর ছাত্রছাত্রীর দল। এই অসম লড়াইয়ে জয়ী হবে কে?
গাছেরা কথা বলতে পারে না। গাছেরা প্রতিবাদ করতে পারে না। তাই নির্বিচারে, অমানবিক রূপ তাদের দেখানো যায়। ধ্বংস করা যায়, নষ্ট করা যায়, আরও অনেক কিছু। তাতে ক্ষতি হলেও আপত্তি নেই, আপাত সুখই শেষ কথা। পরিবেশবিদরা চিন্তা করেন, আবহাওয়াবিদরা আশঙ্কার কথা শোনান, তাতেও পুঁজিবাদের টনক নড়ে না। বরং আরও ক্রূর মূর্তিতে সে সামনে আসে।
এ দেশ, এ বিশ্ব, এ প্রকৃতি এমনই কতশত ঘটনার সাক্ষী তার হিসেব নেই। সাম্প্রতিক ঘটনাও সেই তালিকার অন্যতম শরিক। গল্পের কেন্দ্রে রয়েছে পশ্চিম হায়দরাবাদের ‘ইউনিভার্সিটি অফ হায়দরাবাদ’ সংলগ্ন কাঞ্চা গাছিবোওলি নামের বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল। কয়েকশো ভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ আর প্রাণী ছাড়াও এখানে আছে দুটি জলাধার এবং বেশ কয়েকটি নজরকাড়া প্রাকৃতিক শিলা স্থাপত্য। তবে এই ৪০০ একর সম্ভাবনাময় বনজমি নাকি অকারণ পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে। তাকে বুলডোজারের সাহায্যে একেবারে গোড়া থেকে উপড়ে দিতে পারলে কত অনায়াসে সেখানে বাস্তবায়িত করা যাবে অত্যাধুনিক আইটি পার্ক, সুবিশাল স্কাইস্ক্রেপার ও আরও নানান আধুনিক ব্যবস্থাপনা সম্বলিত একগুচ্ছ প্রকল্প। থাকবে আকাশছোঁয়া উন্নয়নের সম্ভাবনা, পাঁচ লক্ষ কর্মসংস্থানের সুবন্দোবস্ত, সাদর আমন্ত্রণ জানানো যাবে ৫০,০০০ কোটি টাকারও বেশি বিনিয়োগকে। এর বদলে সামান্য কয়েকটা আবাসিক হরিণ, ময়ূর, বুনো শুয়োর, ইত্যাদি মরবে। উৎপাটন করা হবে স্থানীয় গাছগাছালি আর প্রাচীন বৃক্ষরাজি। দ্রুত গতিতে কাজ এগোলে দুদিনে ২০০ একর জমি সাফ করে ফেলা বড় কোনও ব্যাপারই নয়!।
তাই বলে কি প্রকৃতির কথা একেবারে ভাবা হচ্ছে না? ‘তেলেঙ্গানা স্টেট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইনফ্রাস্ট্রাকচার কর্পোরেশন’ আশ্বাস দিয়েছে, প্রখ্যাত মাশরুম শিলা এবং এটির মতন অন্যান্য সুপরিচিত প্রাকৃতিক শিলা স্থাপত্যগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হবে না। স্থানে স্থানে অল্প সবুজও ছেড়ে রাখা হবে, যা আশপাশ দিয়ে গজিয়ে ওঠা ভবিষ্যৎ অট্টালিকাগুলোর শোভাবর্ধনে কাজেই আসবে বরং!
সরকারের মদতে ভালোভাবে এগোচ্ছিল সব। কাজে লেগে পড়েছিল বুলডোজার সমেত মানুষের দলবল। স্রেফ বিজাতির অনুপ্রবেশের আভাস পেয়ে সন্ধের অন্ধকারে দলে দলে হরিণেরা তাদের চিরকালীন আবাস ছেড়ে পালাচ্ছিল। রাতের নৈঃশব্দ্য খানখান হয়ে যাচ্ছিল ঘরছাড়া ময়ূরদের হৃদয়বিদারী বিলাপে। সে চিৎকার অবশ্য কারও কানে পৌঁছয়নি। বাধ সাধল একদল অল্পবয়সী ছেলেপুলে। ইউনিভার্সিটি অফ হায়দরাবাদ-এর ছাত্রছাত্রীর দল। বেমক্কা পোস্টার, ফেস্টুন নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল জঙ্গল আগলে ধরে। বলতে লাগল, চারশো একর জমি কেটে ন্যাড়া করে দিলে সমগ্র হায়দরাবাদের তাপমাত্রা মাত্র এক বছরের মধ্যে ৪ ডিগ্রি বেড়ে যেতে পারে। যেখানে সারা পৃথিবী বিশ্ব উষ্ণায়নকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে, সেখানে রাজ্য আধিকারিকদের এমন পদক্ষেপ রীতিমত ভীতির উদ্রেক করে। তাছাড়া এ বনভূমি প্রাণীদের একমাত্র বাসস্থান। নির্বিচারে কেউ তা ধ্বংস করতে পারে না, সরকারও না!
পুলিশবাহিনী লাঠি চার্জ শুরু করল। দ্বিধাহীনভাবে সরিয়ে দেওয়া হল বিক্ষোভকারীদের। তাতে তারা দমল তো না-ই, জানিয়ে দিল, প্রয়োজনে আমরণ অনশন চলবে। একটি গাছের গায়েও আঁচড় লাগার আগে উত্তর দিতে হবে তাদেরকে! সরকারপক্ষ জানালো, কাঞ্চা গাছিবোওলি-র উপর সম্পূর্ণ অধিকার কেবল রাজ্য সরকারের; বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মত সেখানে নিষ্প্রয়োজন। বিক্ষোভকারীরা জবাব দিল, সম্পত্তি যারই হোক, প্রাকৃতিক সম্পদের ধবংস করবার অধিকার কারুর নেই!
খুব কি অচেনা কিছু হল?
একেবারেই না। বরং, এসব ঘটনা থেকে কয়েক বছর পিছিয়ে গেলেই হরিদ্বারের ঋদ্ধিমা পান্ডে-কে খুঁজে পাওয়া যাবে। কার্বন নির্গমনের মাত্রা না নির্ধারণের দায়ে যে সতেরো বছরের তরুণী মামলা রুজু করেছিলেন রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে। আর একটু পিছোলে অমলা রুইয়া, আবিদ সুরতি, আয়াপ্পা মাসাগি-দের। যারা বিন্দু বিন্দু জল সংরক্ষণের জন্য লড়াইয়ে নেমেছেন ভারতের নানান প্রান্তে। আরও অনেকখানি পিছিয়ে গেলে, উত্তরাখণ্ডের নারীরা শরীর দিয়ে বেড় দিয়েছেন গাছেদের, উদ্দেশ্য, তাদের রক্ষা করা। তখনও কেউ জানে না যে এই আন্দোলনের নাম পাকাপাকিভাবে জায়গা করে নেবে ইতিহাসের পাতায়। স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে লড়াইয়ের চেহারা একই রয়ে গিয়েছে। পক্ষে মানুষ, বিপক্ষে মানুষ। মধ্যে প্রকৃতি। মানুষ অক্লেশে জঙ্গল কেটে সাফ করে ফেলছে, প্রাণীদের উপর অত্যাচার করছে। মানুষই আবার আওয়াজ তুলছে জীবজগতের হয়ে। প্রাণ বাজি রেখে তাদের সংরক্ষণের অঙ্গীকার গ্রহণ করছে। মানুষের বিরুদ্ধে লড়ছে মানুষ। কিন্তু পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়বে কে?