শরৎ আসে যায়, মেঘের ফাঁকে নীল। সবুজ গাছে ঘেরা প্রেমের সুরঙ্গে লাগে কাঁচা হলদেটে রঙের ছোঁয়া। তখন তার রূপ আরও খোলতাই হয়। রেললাইন ধরে আসে যায় কু ঝিক ঝিক ট্রেন। যুদ্ধের দেশের ভিতরে আজও জেগে রয়েছে আশ্চর্য সুন্দর সেই প্রেমের সুড়ঙ্গ। তেমন করে চাইতে পারলে সেখানে ইচ্ছেপূরণ হবেই হবে। কবে থামবে এসব রক্তক্ষয়ী লড়াই-যুদ্ধ? কবে আবার হাত ধরে সেখানে ভিড় করে দাঁড়াবেন প্রেমিক-প্রেমিকারা? তাঁরই অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে আছে ইউক্রেনের আশ্চর্য সেই ‘টানেল অব লাভ’। শুনে নিন।
আজ সেখানে যুদ্ধের ছায়া। যেদিকে তাকানো যায় ধ্বংসস্তূপ শুধু। শান্তশিষ্ট ইউক্রেনে আজ কেবলই বারুদের বন্ধ। মাথার উপর চক্কর কাটছে পারমাণবিক হামলার আতঙ্ক। প্রাণভয়ে দেশ ছাড়ছেন অসংখ্য দেশবাসী। অথচ দিন কয়েক আগেও সে দেশ ছিল মায়ায় ঢাকা। সবুজে ঢাকা প্রেমের সুড়ঙ্গ দিয়ে চলে যেত মায়াবী ট্রেন। ইউক্রেনের টানেল অব লাভ ছিল সেখানকার অন্যতম দ্রষ্টব্য স্থান।
ইউক্রেনের রিভাইন অঞ্চলের কাছে ক্লেভান শহর। সেখানে ফাইবার বোর্ড ফ্যাক্টরির দিকে যে রেললাইন যায়, তার তিন কিলোমিটার দূরে গেলেই দেখা মিলবে সেই প্রেমের সুরঙ্গের। প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে সবুজ গাছেরা শাখার সঙ্গে প্রশাখা মিলিয়ে মিলিয়ে তৈরি করেছে আশ্চর্য ব্যারিকেড। যেন সেই ভুবনে পৌঁছতে পারলেই যেন গাছেরা পাহারা দেবে আপনাদের। স্থানীয়দের বিশ্বাস, সত্যিই মায়াবী ওই সুড়ঙ্গ। সেখানে রয়েছেন ইচ্ছাপূরণের দেবতা। তাই সেখানে গিয়ে যা চাওয়া যায়, তা মিলতে পারে অনায়াসেই। হ্যাঁ, অনেকটা ভূতের রাজার দেওয়া বরের মতোই।
আরও শুনুন: বন্ধুত্বের আবার ‘দেশ’ হয় নাকি! ইউক্রেনের শরণার্থী শিশুকে জড়িয়ে ধরে স্কুলে স্বাগত জানাল খুদেরা
ক্লেভান শহরের উপান্তে অসম্ভব সুন্দর ওই জাগয়াটি বেশ কয়েক বছর অজানাই ছিল ইউক্রেনবাসীর কাছে। বছর দশেক আগে থেকে জনপ্রিয় হতে থাকে জায়গাটি। গাছেদের নরম ছায়ায় যে দিব্য ঘুমিয়ে রয়েছে আশ্চর্য একটা ট্রেন লাইন, তা এতদিন যেন চোখেই পড়েনি। পর্দায় দেখে প্রযুক্তির কারিকুরি বলে মনে হতেই পারে। তবে খালি চোখে সত্যিই অপূর্ব সুন্দর এই প্রেমের সুরঙ্গ। শরৎ পড়তে না পড়তেই হলদে হতে থাকে গাছের পাতা। তখন সে সুরঙ্গের রূপ অন্যরকম।
কথিত আছে, পোল্যান্ড থেকে আসা এক ইঞ্জিনিয়ার নাকি ক্লেভানের একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন। ওরজেভ এলাকা থেকে ক্লেভানে প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে আসার পথটুকু ছিল বেশ কষ্টের। তাই ওই গাছের ছায়াঘেরা পথ জুড়ে আস্ত একটা রেললাইন বানিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। সেই ট্রেনে চেপেই নাকি প্রিয়তমার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন তিনি।
সে গল্প কতটা সত্যি মিথ্যে জানা নেই। তবে শোনা যায়, আদতে সেনাবাহিনীর প্রয়োজনেই নাকি ওখানে রেললাইন পাতা হয়েছিল এক কালে। আর সেই রেললাইন যাতে সহজে চোখে না পড়ে, তার জন্যই গাছ দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছিল জায়গাটি। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একদিন সেনাবাহিনীর কাছে অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ল ওই লাইন। কিন্তু প্রকৃতির খেয়াল আর ট্রেনের চলাচলের কারণে সেখানে তৈরি হল আশ্চর্য প্রাকৃতিক এক সুড়ঙ্গ, যা ইউক্রেনে ‘টানেল অব লাভ’ বলেই খ্যাত।
আরও শুনুন: এখন ব্যবসার সময় নয়! যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনে মানুষের মুখে বিনামূল্যে খাবার তুলে দিচ্ছে অসংখ্য রেস্তরাঁ
এখনও পর্যন্ত নানা ভাষার বহু ছবির শুটিং করা হয়েছে এই সুড়ঙ্গে। ইউক্রেনের এই আশ্চর্য সুড়ঙ্গ দেখতে ভিড় করতেন বহু পর্যটকই। তবে যুদ্ধ এসে যেন তালগোল পাকিয়ে দিয়েছে সবটাই। প্রেমের সুরঙ্গে যাওয়ার মতো লোক আজ অমিল। সবাই প্রাণ বাঁচাতে ছুট লাগাচ্ছেন দেশ ছেড়ে। যাঁরা রয়ে গিয়েছেন, তাঁদের প্রতিমুহূর্তে তাড়া করে বেড়াচ্ছে আতঙ্ক। এই বোধহয় রুশ বোমা নেমে এল, দুমড়েমুচড়ে শেষ করে দিল ঘরদোর, শহর সব কিছু। ইউক্রেনে প্রেমের সুরঙ্গ রয়েছে বটে, তবে দেশ জুড়ে কবে শান্তি ফিরবে, তা বোধহয় কেবল যুদ্ধবাজেরাই বলতে পারবেন।