ঋষি গৌতমের অভিশাপে পাথর হয়ে গিয়েছিলেন অহল্যা। শ্রীরামচন্দ্রের স্পর্শে সেই পাথরে পুনরায় প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয়েছিল। সে তো পৌরাণিক কাহিনি। কিন্তু যদি বলি পাথর জ্যান্তও হয়, তবে কি বিশ্বাস করবেন! কার ছোঁয়ায় যে এ পাথর এক্কেবারে জীবন্ত, তা বোধহয় জানেন না কেউই। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কলেবর বৃদ্ধি পায় এই পাথরের। শুধু তাই নয়, বংশবৃদ্ধিও করতে পারে এই আশ্চর্য পাথর! আসুন, শুনে নিই সেই অদ্ভুত পাথরের কথা।
পাথরের প্রাণ নেই! কে বলে! এমন একটা পাথর আছে যে নাকি রীতিমতো জ্যান্ত। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আকারে আয়তনে বাড়ে তো বটেই, প্রয়োজনে বংশবিস্তার করতেও ওস্তাদ এ পাথর।
ভাবছেন নিশ্চয়ই এ সব গল্প কথা। একেবারেই নয়। বরং বাস্তবেই রয়েছে এমন পাথর। এ পাথরের নাম ‘ট্রোভান্ট’। যার দেখা মিলবে একমাত্র রোমানিয়ায়। স্থানীয়রা অবশ্য একে দৈব পাথর বলতেই বেশি পছন্দ করেন। আকারের পাশাপাশি মাঝেমধ্যে জায়গাও নাকি বদল করে ফেলে এ পাথর।
অদ্ভুত কাণ্ড তো বটেই। কস্মিনকালেও কেউ শুনেছে নাকি, পাথর মানুষের মতো হাঁটে চলে, বাড়ে। বংশবিস্তার করে। তবে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ভৌতিক কিছুই নয়, এর পিছনেও রয়েছে যুক্তি। আসলে এই পাথরের ভিতরে থাকে একটা শক্ত ‘কোর’। বাকি অংশটা তৈরি হয় ক্যালসিয়াম কার্বনেট সমৃদ্ধ ছিদ্রযুক্ত বেলেপাথর দিয়ে। জলের সংস্পর্শে এলেই রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে ওই পাথরে। আর বাইরের ওই স্তর তখন সিমেন্টের মতো শক্ত হয়ে যায়।
আরও শুনুন: সময়ে-অসময়ে ভেসে আসে সুর, থেকে থেকে গান গেয়ে ওঠে ‘রহস্যময়’ সেতু!
প্রতিবার ভারী বৃষ্টির পরে, জলের মধ্যে থাকা সমস্ত খনিজ পদার্থ শুষে নেয় এই পাথর। পরে পাথরের মধ্যে থাকা উপাদানের সঙ্গে সেসবের বিক্রিয়ার ফলে পাথরের অন্দরে সৃষ্টি হয় চাপ। যার ফলে আকার ও আয়তনে পরিবর্তিত হতে থাকে পাথরগুলি। প্রায় ১০ মিটার পর্যন্ত আকারে বাড়তে পারে পাথরটি। শুধু তাই নয়, পাথরের বিভিন্ন খাঁজ থেকে আরও ছোট ছোট পাথরের জন্ম হতে থাকে। গাছের ডাল যেভাবে শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে, সেভাবেই এই পাথরও জলের সংস্পর্শে এসে বংশবৃদ্ধিও করে। সেই ছোট ছোট পাথরগুলি আবার হাজার বছর ধরে বৃদ্ধি পেতে পারে কয়েক সেন্টিমিটার পর্যন্ত।
১৯৯০ সালে জিওলজিস্ট ডি এম মার্গোকি তাঁর লেখা একটি বইয়ে এই পাথরের কথা উল্লেখ করেন। ‘ট্রোভান্ট’ নামটিও দিয়েছিলেন তিনিই। তবে তার বহু আগে থেকেই রোমানিয়ায় এই পাথরের ব্যবহার চলে আসছে। দেবদেবী থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রাণীর মূর্তি ওই পাথর দিয়েই তৈরি করতেন এখানকার প্রাচীন মানুষেরা।
বৈজ্ঞানিকেরা দেখেছেন, এই পাথরের ভিতরে রয়েছে একধরনের চক্রাকার দাগ। গাছের গুঁড়ি কাটলে যেমনটা দেখা যায়, অবিকল তেমনই। এই পাথরকেও মাঝবরাবর কেটে পরীক্ষা করেছেন তাঁরা। পাথরের অভ্যন্তরে ভিন্ন বর্ণ ও ঘনত্বের স্তরও রয়েছে নাকি। তবে সে সবের ব্যাখ্যা খুঁজে পাননি গবেষকেরা। ভূতাতাত্ত্বিকেরা মনে করেন, ৬০ লক্ষ বছর ভূমিকম্প কিংবা আগ্নেয়গিরির লাভা থেকে তৈরি হয়েছিল পাথরগুলি। তার পরে তা ক্রমশ বংশবিস্তার করে করে পৃথিবীতে থেকে গিয়েছে।
আরও শুনুন: দেওয়াল থেকে সিঁড়ি সবই তৈরি হয়েছে নুন দিয়ে! মাটির নিচে রয়েছে এই ‘ঈশ্বরের ঘর’
তবে স্থানীয়দের কাছে আজও আশ্চর্য এই ট্রোভান্ট পাথর। কেউ মনে করেন ভিনগ্রহের জিনিস, কেউ বা মনে করেন মহাজাগতিক উল্কাপাতের ফলেই সৃষ্টি হয়েছিল ওই জীবন্ত পাথর। রোমানিয়ার কোসটেসতি গ্রামে এই ট্রোভান্ট পাথরের একটি মিউজিয়ামও রয়েছে, যেটির দেখভাল করে ইউনেস্কো। তবে এ পাথরকে পাথর বলা হবে না গাছ, এ নিয়ে এখনও সংশয় কাটেনি। এ পাথর জড় না জীবন্ত, তা নিয়েও দ্বন্দ্ব চলে সবসময়। আর এই রহস্যই পর্যটকদের কাছে দিন দিন আকর্ষণীয় করে তুলেছে রোমানিয়ার ওই গ্রামটিকে। সচক্ষে জ্যান্ত পাথর দেখার অভিজ্ঞতা, কেই বা ছাড়তে চায় বলুন তো!