যাঁরা নিয়মিত শরীরচর্চা করেন, তাঁরা তো ট্রেডমিল ব্যবহার করেই থাকেন। তাঁদের বাইরেও ট্রেডমিলের নাম বর্তমানে অনেকেরই জানা। কেবল কয়েক পা হেঁটে ঘাম ঝরানোর মতো সহজ উপায় এনে দিয়েছে যে যন্ত্র, ব্যস্ত দুনিয়ায় তার কদর বেড়েই চলেছে। কিন্তু জানেন কি, এই যন্ত্র তৈরি করার পিছনে আসলে কোন উদ্দেশ্য ছিল?
আজকের সংশোধনাগারে আবাসিকরা যে কাজ করেন, তার জন্য তাঁরা পারিশ্রমিক পান। কিন্তু সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয় যে জেলবন্দিদের, তাদের ক্ষেত্রে সেই কাজ করাটা আসলে শাস্তিরই একটা অংশ। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, সেই কাজের অভিজ্ঞতা খুব একটা আরামদায়ক হওয়া সম্ভব নয়। কাজ আর শাস্তিকে এমন করে মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা থেকেই জন্ম নিয়েছিল আজকের ট্রেডমিল।
আরও শুনুন: সোনালি রাংতায় মোড়া শিশুশ্রমিকের যন্ত্রণা, স্বাদের আড়ালে লুকিয়ে চকোলেট ইন্ডাস্ট্রির রূঢ় বাস্তব
সেটা ১৮১৮ সাল। উইলিয়াম কিউবিট নামে এক ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ারের মনে হল, ব্যুরি সেন্ট এডমন্ডস জেলে যেসব বন্দিরা রয়েছে, তারা খামোখা সরকারের পয়সায় খেয়ে খেয়ে মোটা হচ্ছে। তাহলে আর শাস্তি হল কীসের! এমন একটা কোনও উপায় বের করা দরকার, যাতে এই ব্যাটাদের শাস্তিটা বেশ জোরদার হয়, আবার তার ফলে কর্তৃপক্ষেরও কোনও একটা সুরাহা হতে পারে। কিউবিটের বাবা ছিলেন কারখানার মালিক। সুতরাং ছেলের মাথায় পরিশ্রম আর উৎপাদনের অঙ্কটা পরিষ্কার ছিল। ভেবেচিন্তে তিনি একটা যন্ত্র বানিয়ে ফেললেন, যাতে একইসঙ্গে এই অকম্মার ঢেঁকিদের শিক্ষা দেওয়া যায়, আবার তাদের শারীরিক শক্তিকে ব্যবহার করেই শস্য মাড়াইয়ের কাজটাও চলে। যন্ত্রটার নাম দিলেন ট্রেড হুইল। সেটা আসলে একটা হুইল বা চাকা, আড়াআড়ি একটা অক্ষকে ব্যাস করে ঘোরে। ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য একটা রেলিং জুড়ে দেওয়া হয়েছিল চাকার সঙ্গে, সেই রেলিং ধরে চাকার বাইরের দিকে দাঁড়িয়ে ক্রমশ উপরের দিকে উঠত সাজাপ্রাপ্ত বন্দিরা। যেন এক অনন্ত সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাওয়া। সঙ্গে সঙ্গে চাকার ঘর্ষণে মাড়াই হয়ে যেত নিচে রাখা শস্য।
আরও শুনুন: স্রেফ একটি কুকুরের কারণেই দুই দেশের মধ্যে হল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, জানেন এই ঘটনা?
১৮৬৫ সালের জেল আইন স্থির করল, ১৬ বছরের উপরের বয়সি যে কোনও সশ্রম কারাদণ্ড পাওয়া বন্দিকেই তিন মাস প্রথম শ্রেণিতে কাজ করতে হবে। এই শ্রেণিরই অন্তর্ভুক্ত ছিল ট্রেডমিল। ১৮২১ সালে নিজের হাতে যে যন্ত্রটি বসিয়েছিলেন কিউবিট, ব্রিক্সটন জেলের সেই ট্রেডমিলটি ছিল ভয়ংকর। তখন উইন্ডমিল দিয়ে গম ভাঙা, শস্য মাড়াই করার কাজ চলত। আর হাওয়াকলের গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে হত এই ট্রেডমিলে কাজ করা বন্দিদের। কুড়ি ফুট লম্বা প্যাডলের ওপর দাঁড়িয়ে দিনে ছয় ঘণ্টা বা তারও বেশি এই অমানুষিক পরিশ্রম করতে হত তাদের। যা ১৫০০ থেকে মিটার হাঁটার সমান।
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধেও বিভিন্ন কারাগারে এই যন্ত্রটি ব্যবহার করা হত। নিষ্ঠুরতার অভিযোগে ক্রমে ক্রমে এটি বাতিল হয়ে যায়। তবে আরও কিছুদিন পরে ফের ফিরে আসে, অন্য রূপ নিয়ে। ১৯১৩ সালে প্রথম শরীরচর্চার জন্য ট্রেনিং মেশিন হিসেবে ট্রেডমিলের পেটেন্ট নেওয়া হয়। যে ট্রেডমিলের জনক ছিলেন আরেক ইঞ্জিনিয়ার, উইলিয়াম স্টব। মানুষের প্রতি অত্যন্ত নিষ্ঠুরতা, অবিচারের সাক্ষ্য দিত যে যন্ত্র, এবার মানুষের উপকার করার জন্যই কাজ শুরু হয় তার।