মা আর সন্তানের মধ্যে নাড়ির যোগ। এ কথা তো সবারই জানা। আবার সেই সম্পর্কের সুতোয় যে টান লাগে, তাও সত্যি। দেখা যায়, বয়স যত বাড়তে থাকে মায়ের কথা আর তেমন করে শুনতে চায় না সন্তান। নির্দিষ্ট কোনও একজন নয়, প্রায় সকলের ক্ষেত্রেই ঘুরেফিরে এ কথা প্রযোজ্য। কিন্তু কেন হয় এমনটা? এবার তারই কারণ খুঁজে বের করলেন বিজ্ঞানীরা। আসুন শুনে নিই।
যে সন্তান ছিল বাধ্য, মায়ের কথা শুনত এবং মেনে চলত অক্ষরে অক্ষরে, সেই সন্তানই যখন বয়ঃসন্ধির দোরগোড়ায় পৌঁছাল, তখন যেন আর মায়ের কথা কিছুতেই শুনতে চায় না। এ যেন ঘর ঘর কি কহানি। কিন্তু না, এর জন্য সন্তানদের দোষ দিয়ে বিশেষ লাভ নেই। তারা যে ইচ্ছে করেই অবাধ্য হয়ে উঠছে, ব্যাপারটা কিন্তু ঠিক সেরকম নয়। বরং বলা যায়, এটা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আর তারই হদিশ দিলেন একদল বিজ্ঞানী।
আরও শুনুন: উদ্ধার করতে হবে পরীক্ষার প্রশ্ন, বিপদে পড়ে দমকল বাহিনী ডাকল স্কুল
জন্মের আগে থেকেই মায়ের কণ্ঠস্বরের সঙ্গে বাচ্চার কীরকম সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তা নিয়েও হয়েছিল গবেষণা। সেই গবেষণারই আরও একটু প্রসারিত রূপ বলা যায় নয়া এই গবেষণাটিকে। যা খতিয়ে দেখেছে বয়ঃসন্ধি পর্যায়ের ব্যবহারকে। স্ট্যান্ডফোর্ড স্কুল অফ মেডিসিনের তরফে এই গবেষণাটি করা হয়েছিল, যা প্রকাশিত হয়েছে জার্নাল অফ নিউরোসায়েন্সে। বাচ্চারা শৈশবে যেরকম ব্যবহার করে, বড় হয়ে কেন তা পালটে যায়, এই প্রবণতা চিহ্নিত করে এর নিউরোবায়োলজিক্যাল ব্যাখ্যা দেন গবেষকরা। এর জন্য ব্রেনের এমআরআই স্ক্যান করেন তাঁরা। গবেষণার ফলাফল হিসাবে যা উঠে এসেছে তা চমকপ্রদ। দেখা যাচ্ছে, শৈশবে বাচ্চা একটি কণ্ঠস্বরের সঙ্গেই পরিচিত থাকে বেশি। তা হল মায়ের কণ্ঠস্বর। মায়ের স্বরের সঙ্গে তাই বাচ্চার একটি ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে ওঠে। তা বহুদিন পর্যন্ত বজায় থাকে। এর ফলে শৈশবে মায়ের কথা শোনার প্রবণতা সবথেকে বেশি থাকে বাচ্চাদের। ক্রমশ বয়স যত বাড়তে থাকে, অর্থাৎ বয়ঃসন্ধির দিকে যত এগোতে থাকে বাচ্চা, তত অন্যান্য স্বরের সঙ্গে তার পরিচিতি বাড়ে। মস্তিষ্কের সক্রিয়তাও সেভাবে বদলাতে থাকে। ফলে কোনও এক ধরনের স্বর বা এক ধরনের কণ্ঠের প্রতি আকৃষ্ট না থেকে, সে অন্যান্য কণ্ঠস্বরের প্রতিও মনোযোগী হয়ে ওঠে। প্রত্যাশিত ভাবেই এই পর্বে কেবলমাত্র মায়ের কথা শোনায় সে সীমাবদ্ধ থাকে না। বরং আরও নানা কথা শুনতে আগ্রহী হয়। ঠিক এই কারণেই বাচ্চা যত বড় হতে থাকে, তত মায়ের কথা শোনার প্রবণতা তার কমে।
আরও শুনুন: লক্ষ্য সারা বিশ্বে বিনামূল্যে শিক্ষা পৌঁছে দেওয়ার, ভারচুয়াল স্কুল গড়ার স্বপ্ন যুবকের
তাহলে কী দেখা গেল? সাধারণত যা আমরা অবাধ্যতা বলে ভেবে থাকি, বাস্তবে তা কিন্তু নয়। বরং গবেষকরা এই প্রবণতাটিকে ভালোই বলছেন। ম্যাচুরিটি বা বোধবুদ্ধির স্বাস্থ্যকর পরিণতির দিকেই বাচ্চা এগোচ্ছে, এই প্রবণতা আসলে তারই প্রমাণ দেয়। গবেষকরা বলছেন, এর অর্থ আসলে বাচ্চাটির পৃথিবীর বৃহত্তর ক্ষেত্রের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ছে। পরিবারের বাইরে যে সামাজিক পরিসর, এই পর্বে তার সঙ্গে পরিচয় এবং যোগাযোগ বাড়ছে বলেই জানা যাচ্ছে। বন্ধুবান্ধব থেকে শুরু করে যত পরিচিত বৃত্ত বাড়তে থাকে, তত অজানা জিনিস, নতুন ঘটনা বা তথ্য জেনে নেওয়ার প্রবণতা বাড়তে থাকে। অর্থাৎ এই পর্বে একজন মানুষ অনেকটা পরিণত হয়ে ওঠে। তার চিন্তা-ভাবনা বোধবুদ্ধি পালটে যায় অনেকখানি। একই অনুপাতে বদলায় তার উত্তর দেওয়া বা প্রত্যুত্তরের প্রবণতা। পরিবার বা পারিবারিক সীমানা কাটিয়ে সে নিজেকে মেলে ধরে বা ধরতে চায় বৃহত্তর ক্ষেত্রে। অর্থাৎ, বড় হলে বাচ্চা মায়ের কথা শোনে না বলে যে অভিযোগ, তা আসলে একটু অন্যরকম। বলা যায়, মায়ের কথা ছাড়াও আরও অনেক কথা শোনার দিকে তার মন যায়। আর মনের এই চলাচল স্বাস্থ্যকর লক্ষণই। অন্তত এই গবেষণা সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে।