সমুদ্রসৈকতে পড়ে আছে এক তরুণীর দেহ। বিকিনির আড়াল থেকে ফুটে উঠেছে তার যৌবন। সারা দেহে অত্যাচারের চিহ্ন। সেই প্রথমবার। তারপর একইভাবে পাওয়া গেল আরও কয়েকজন তরুণীর দেহ। আশ্চর্যের কথা হল, তাদের প্রত্যেকের পরনেই ছিল বিকিনি। তাই অজ্ঞাতপরিচয় এই খুনির নাম হয়ে গেল ‘বিকিনি কিলার’। শুনে নিন এই ভয়ধরানো সিরিয়াল কিলারের গল্প।
অবাধ যৌনতার স্বর্গরাজ্য এই এলাকা। দিনেরাতে বয়ে যায় মদের ফোয়ারা। আর মদের গ্লাস হাতে সুন্দরী তরুণীদের ভিড়ে চোখে ধাঁধা লেগে যায় যেন। বিকিনি কিংবা স্যুইমস্যুটের আড়াল থেকে উপচে পড়ে তাদের উদ্ধত যৌবন। নাচের তালে স্কার্ট উড়তে থাকে কারও। আর সেইসব খোলামেলা নারীশরীর দুচোখ দিয়ে লেহন করে পুরুষেরা। ফুর্তি করার জন্য এমন জায়গা কমই মেলে। তাই সারা বিশ্ব থেকেই এখানে জড়ো হয় পর্যটকেরা। আর সেইখানেই কিনা পরপর খুন। খুন হচ্ছে যারা, তারা সকলেই তরুণী। সারা দেহে আঘাতের চিহ্ন, কারও কারও গলায় ফাঁসের দাগ। আর আশ্চর্যের কথা হল, তাদের প্রত্যেকের পরনেই ছিল রংবেরঙের বিকিনি। এ আবার কেমন কথা! বিকিনির প্রতিই এমন আকর্ষণ কেন এই ঘাতকের? তার উত্তর কে-ই বা দেবে! কিন্তু মুখে মুখে এই অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ীর নামই হয়ে গেল ‘বিকিনি কিলার’। আর এই সিরিয়াল কিলারকে খুঁজতে ঝাঁপিয়ে পড়ল পুলিশ আর গোয়েন্দারা।
আরও শুনুন: নেশা বিকৃত যৌনতার, খুন করে অন্তর্বাস জমিয়ে রাখার শখ সিরিয়াল কিলারের
এ ঘটনা ঘটেছিল পাটায়া-তে। সেখানকার একটি সমুদ্রসৈকতেই প্রথম এক তরুণীর মৃতদেহ পাওয়া যায়। সেটা ১৯৭৫ সালের অক্টোবর। কিন্তু এই বিকিনি কিলার আসলে কে, সে কথা জানা গিয়েছিল আরও খানিক পরে। ১৯৭৬ সালে ভারত থেকেই ধরা পড়ে এক অপরাধী। জানা যায়, দিল্লিতে একদল ফরাসি তরুণকে নিশানা করেছিল সে ও তার আরও তিন সঙ্গী। গাইড হিসেবে তাদের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে তাঁদের হাতে তুলে দিয়েছিল বিষ মেশানো পিল। কিন্তু সেই ছাত্ররা তাদের মতলব বুঝতে পেরে তাদের কাবু করে ফেলে। তুলে দেয় পুলিশের হাতে। আর সেই তদন্তেই ফাঁস হয়ে যায়, আসলে ওই হত্যাকাণ্ডগুলিও এই অপরাধীরই কীর্তি, যার নাম চার্লস শোভরাজ।
একের পর এক অপরাধ ঘটিয়ে বিশ্বের অপরাধ মানচিত্রে পাকাপাকিভাবে ঠাঁই করে নিয়েছিল শোভরাজ। তার বাবা ভারতীয়, মা ভিয়েতনামের মেয়ে। ছোটবেলাতেই অবশ্য দুজনের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। তার মা নতুন সংসার বেঁধেছিলেন ফরাসি প্রেমিকের সঙ্গে। ফরাসি সেনাবাহিনীর সেই লেফটেন্যান্ট দত্তকও নিয়েছিলেন শোভরাজকে। কিন্তু নতুন পরিবারে মানিয়ে নিতে পারেনি শোভরাজ। পরিবার থেকে আলাদা হতে হতে সে পা রেখেছিল অপরাধের দুনিয়ায়। ১৯ বছর বয়সেই প্যারিসে ডাকাতির ঘটনায় প্রথমবার কারাবন্দি হয় শোভরাজ। তারপরেও বিন্দুমাত্র শোধরায়নি সে। এদিকে তার অপরাধের সব ইতিহাস জেনেও তার প্রেমে পড়েন প্যারিসের এক অভিজাত পরিবারের তরুণী। অপরাধ আর প্রেম, দুইই চলতে থাকে সমান তালে। ১৯৭০ সালে পুলিশের হাত এড়াতেই অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে ফ্রান্স ছেড়ে এশিয়ার উদ্দেশে রওনা দেয় শোভরাজ। নকল নথিপত্র নিয়ে এসে পড়ে মুম্বইয়ে। সেখানে শুরু করে গাড়ি চুরির চক্র। এরপর কাবুল, ইরান… মধ্যপ্রাচ্য এবং পূর্ব ইউরোপের নানা দেশে থাকতে শুরু করে শোভরাজ। পর্যটকদের পাসপোর্ট চুরি করেই অন্য দেশে যাওয়ার ছাড়পত্র জোগাড় করত সে। ততদিনে তার অপরাধের ভারে ক্লান্ত স্ত্রী প্যারিসে ফিরে গিয়েছেন। সুতরাং ঝাড়া হাত পা হয়ে নিজের কানাডার প্রেমিকার সঙ্গে ব্যাংককে পৌঁছয় শোভরাজ। আর তারপরেই পাটায়ার হত্যাকাণ্ড। মনে করা হয়, সত্তরের দশকে প্রায় ২০ জনকে খুন করেছিল শোভরাজ।
আরও শুনুন: কিশোরীদের রক্তে স্নান, ৬০০ জনকে খুন, কুখ্যাত মহিলা সিরিয়াল কিলারের রুদ্ধশ্বাস গল্প
ভারতে ধরা পড়ার পরে ১২ বছরের কারাদণ্ড হয় শোভরাজের। কিন্তু তিহার জেলে কারাবাসের সময় দেহের মধ্যে নানা মূল্যবান রত্ন লুকিয়ে রেখেছিল সে। প্রয়োজনমতো রক্ষীদের ঘুষ দিয়ে সে আরাম বিলাসের উপাদান জুটিয়ে নিত জেলেও। ১৯৮৬ সালে তিহাড়বাসের ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষে কারারক্ষীদের জন্য পার্টি দেয় শোভরাজ। তার পর তাদের ঘুমের ওষুধ মেশানো খাবার খাইয়ে পালিয়ে যায়। তবে এরপর গোয়া থেকে ফের ধরা পড়ে আরও ১০ বছরের সাজা পায় সে। ১৯৯৭ সালে জেল থেকে মুক্তি পেয়ে সে ফিরে যায় ফ্রান্সে। শোনা যায়, সেখানে রাজার হালেই জীবন কাটাত সে। কিন্তু থিতু হয়ে জীবন কাটানো সম্ভবত তার ধাতেই ছিল না। তাই ২০০৩ সালে ফের খবরে উঠে আসে শোভরাজের নাম। এবার তাকে গ্রেপ্তার করেছিল নেপালের পুলিশ। ১৯৭৫ সালে নেপালে দুই বিদেশি নাগরিককে খুনের ঘটনায় তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। সেখানে থাকার সময় জেলে একজন দোভাষী চেয়েছিল চার্লস শোভরাজ। বছর ৬৪-র শোভরাজের দোভাষী হয়ে জেলে পা রাখেন একুশের তরুণী নিহিতা বিশ্বাস, যিনি আবার ছিলেন শোভরাজের আইনজীবীর স্ত্রী। মাত্র তিন মাসের আলাপেই শোভরাজকে বিয়ে করেন নিহিতা, এমন কথা শোনা যায়। জেলের মধ্যেই ২০০৮ সালে গোপনে হিন্দু মতে তাঁদের বিয়ে হয়। বয়স যতই বাড়ুক, শোভরাজের জীবনে বৈচিত্র্য যে এতটুকুও কমেনি, তা ফের প্রমাণ হয়ে গিয়েছিল এই ঘটনায়।