গোটা একটা ট্রেন। তাতে যাত্রীরাও ওঠেন। অথচ এ ট্রেনের চাকা গড়ায় না কখনও। তাই বলে এ ট্রেনে যাত্রীর অভাব আজ পর্যন্ত হয়নি। কী রহস্য লুকিয়ে রয়েছে এর পিছনে? আসুন শুনে নিই।
রেলগাড়ি কু ঝিক ঝিক করতে করতে ছুটে যাবে, পেরিয়ে যাবে বন পাহাড়। তাই তো হওয়ার কথা। তবে এ রেলগাড়ির নড়নচড়ন নেই। তাই বলে তার যাত্রীর অভাব হয়নি কোনওকালেই। অমোঘ আকর্ষণে এ রেলগাড়ির কামরায় উঠে পড়েন অসংখ্য পর্যটক। আশ্চর্যের ব্যপার, গাড়ি নড়ে না, চড়ে না। তবু এ রেলগাড়ি নিয়ে উৎসাহের কমতি নেই যাত্রীদের।
হবে না-ই বা কেন? এ রেলগাড়ির কামরায় মাথা নেড়ে যায় বেবুন। রেলব্রিজের নিচে নদীর জলে সাঁতার কাটে জলহস্তি। হরিণের পিছনে ছুটতে ছুটতে থমকে তাকায় ক্ষীপ্র চিতাবাঘ। এ সব দৃশ্য কি আর চলন্ত রেলগাড়ি থেকে দেখতে পাওয়া যায়। তার জন্য চাই আশ্চর্য ট্রেন। যা আছে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রুগার ন্যাশনাল পার্কে।
আরও শুনুন: সমুদ্রের জলে যখন-তখন আয়েসি সাঁতার! বিলাসবহুল এই সৈকতে রাজার হালে থাকে বরাহবাহিনী
দক্ষিণ আফ্রিকার ওয়াইল্ড লাইফ স্যানচুয়ারিগুলির মধ্যে অন্যতম এই ক্রুগার ন্যাশনাল পার্ক। সেখানেই রয়েছে এই বিলাসবহুল ট্রেন। শুধু ট্রেন বললে ভুল হবে, আসলে এটি একটি বুটিক হোটেল। যেখান থেকে জঙ্গলের এক অনাবিল দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন পর্যটকেরা। সূর্যোদয় থেকে শুরু করে তারা ঢাকা রাতের আকাশ, গোটা ভিউটাই মিলবে এই ট্রেন থেকে।
রয়েছে পর্যটকদের আতিথেয়তার সমস্ত ব্যবস্থাই। ট্রেনের দরজা থেকেই রয়েছে ছোট্ট একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখান থেকে সেতু বেয়ে পৌঁছে যেতে হবে ছোট্ট একটি জলাশয় ঘেরা বাড়ির কাছে। সেখানে ভোর চারটে নাগাদ মিলবে চায়ের বন্দোবস্ত। পাখির কলকাকুলীতে তখন আস্তে আস্তে ঘুম ভাঙছে গোটা জঙ্গলের। হঠাৎ কিসের যেন ডাক একমূহুর্তে ভেঙে দিয়ে গেল ভোরের নিস্তব্ধতা। কিসের ডাক ওটা?
সেতুর রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ততক্ষণে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিয়েছেন যাত্রীরা। হোটেলের ছেলেটি আস্বস্ত করে, ভয়ের কিছু নেই। জলহস্তিরই ডাক ওটা। সাবি নদীর ভিতর থেকে ততক্ষণে চোখে পড়ে গিয়েছে বিশালাকার ওই কান দুটো।
জঙ্গলের মধ্যে দু-একটা রাত্তির যদি বিলাসবহুল ভাবে কাটাতেই হয়, তবে এই রেলগাড়ির তুলনা মেলা ভার। যেমন সুন্দর প্রকৃতি, তেমনই ভাল পরিষেবা। এই রেলগাড়ি থেকেই মিলবে জঙ্গল ভ্রমণের সাফারি ট্রাক। আর সেই ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হবে জঙ্গলের গভীরে। যেখানে রয়েছে জিরাফ, হাতি বা জেব্রাদের ঘরবাড়ি। কপাল ভালো থাকলে দু-একটা বাঘ, সিংহ বা চিতাবাঘেরও দেখা পেয়ে যেতে পারেন।
আরও শুনুন: জলে মুখ দেখলেই বৃত্তের আকার নেয় সেতু! কোথায় রয়েছে এই আশ্চর্য ব্রিজ?
১৯২০ সালের ওই রেললাইনই ছিল জঙ্গলে যাওয়ার একমাত্র রাস্তা। তবে ১৯৭৯ সালের পর বন্ধ হয়ে গেল এই রেলপথের ব্যবহার। রেললাইন আর রেলসেতু- দুটোই পড়ে রইল পরিত্যক্ত হয়ে। দেখলে মনে হবে ধ্বংসস্তূপ। ২০১৬ সাল নাগাদ ওই রেললাইনের ওপর একটি রেল-হোটেল খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। ১৩টি বগি থেকে বাড়িয়ে ২৫ বগির একটি রেলগাড়িকে বানিয়ে তোলা হল ঝাঁ চকচকে হোটেল। প্রত্যেকটি কামরায় রয়েছে একটি করে ঘর। তাতে বিছানা থেকে বালিশ- খামতি নেই কোনও কিছুরই। সঙ্গে রয়েছে একটি ছোট্ট বারান্দা আর স্বচ্ছ কাচের জানলা। যেখান থেকে জঙ্গলকে দেখতে পাবেন দুচোখ ভরে। দেখতে দেখতে ক্রুগার ন্যাশনাল পার্কের অন্যতম আকর্ষণ হয়ে উঠেছে এই রেলগাড়ি হোটেল। প্রতিবছর হাজার দর্শক এই আশ্চর্য হোটেলে ভিড় জমান। তার মধ্যে আন্তর্জাতিক পর্যটকদের সংখ্যাই বেশি। প্রথম কয়েক বছর তো নিঃশ্বাস নেওয়ারও সময় পেতেন না হোটেল কর্মীরা।
জঙ্গলে রাত বাড়ে। হিমের সঙ্গে জাঁকিয়ে বসে শীত। ট্রেন যেন অল্প নড়ে ওঠে। না, কোনও অলৌকিক ব্যাপার নয়। ঠান্ডা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেতুর ধাতব কাঠামো বহরে কমতে থাকে। তার জন্যই বোধহয় হাল্কা গড়াতে থাকে ট্রেন। তবে ভয়ঙ্কর জঙ্গলের মধ্যে বসে তখন অত বাস্তব-বিজ্ঞান মাথায় ঢোকে না। বরং একটু গা ছম ছমই করে ওঠে রেলযাত্রীদের।