‘আমার তিনটি পোষ্য সারমেয় আছে। আমি সিরিজ জিতি বা হারি, তাঁরা কিন্তু সবসময় আমার প্রতি একই রকম ব্যবহার করে।’ – এ-কথা বলেছিলেন, মহেন্দ্র সিং ধোনি। অনেকটা যেন সেই মতেরই ছায়া পড়ছে দাম্পত্যেও। সন্তান নয়, পোষ্যের আদরই অপত্যসুখের বিকল্প হয়ে উঠছে অনেকের কাছে। এঁদের বলা হচ্ছে DINK কাপল। কী এর অর্থ? আর কেনই বা এই প্রবণতা? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
বৈবাহিক সম্পর্ক বা দাম্পত্য সন্তান ছাড়া অসম্পূর্ণ। পরিবারের গড় ধারণা মোটামুটি এই ভাবেই বেশিরভাগ মানুষকে ভাবতে শিখিয়েছে। তবে, এর ব্যতিক্রম আগেও ছিল। যাঁরা এই ধরনের মতে বিশ্বাস করতেন না। ইদানীং সেই ভিন্ন মতাবলম্বীর সংখ্যাই বাড়ছে। অর্থাৎ দাম্পত্যে সন্তানকে স্বাগত জানানো থেকে বিরত থাকছেন অনেকেই। পরিবর্তে পোষ্যের আদরই যেন তাঁদের দিচ্ছে অপত্যসুখের বিকল্পের সন্ধান।
আরও শুনুন: অপুষ্টির বাড়বাড়ন্ত, অন্যদিকে ওবেসিটি মহামারির আশঙ্কা! খাওয়া না-খাওয়ার খেলায় টালমাটাল দেশ
সমাজের এই বদলে যাওয়া ছবি আসলে আকস্মিক নয়। এর পিছনে বহু কারণ আছে। নানা পরিস্থিতির চাপই ক্রমাগত এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করছে। এইরকম ক্ষেত্রে চয়েস-এর ধারণা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সন্তান না নেওয়া কোনও দম্পতির ‘চয়েস’ হতেই পারে। তবে সেই ‘চয়েস’ যে সমস্ত কারণ থেকে জন্ম নিচ্ছে, তাই-ই আসলে বদলের মুখটিকে চিহ্নিত করতে পারে। একেবারে প্রাথমিক ভাবে আর্থিক কারণটিই উঠে আসে। সন্তানের জন্ম, তার প্রতিপালন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার জন্য যে খরচ আজকের দিনে করতে হয়, তা আকশছোঁয়া। সকলেই যে তাতে সমর্থ, এমনটা বলা যায় না। তবে, এখানে আর-একটি বিষয়ও উল্লেখ করার মতো। দেখা যাচ্ছে, আর্থিক সামর্থ্য আছে এমন অনেকেও এই চয়েস-এর দিকেই ঝুঁকছেন। সেখান থেকেই ‘DINK কাপল’- এই টার্মটির জন্ম। এর অর্থ হল, ‘ডুয়াল ইনকাম নো কিডস্’ অর্থাৎ দম্পতি দুজনেই উপার্জনক্ষম। তার পরেও তাঁরা সন্তান নিতে চাইছেন না। সমাজের মন বদলের কথাই এখানে স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
সম্পর্কের খুঁটিনাটি যাঁরা বিশ্লেষণ করেন, তাঁরা বলছেন, দুজনে উপার্জন করেন মানেই কিন্তু অর্থের প্রসঙ্গটি একেবারে মুছে যাচ্ছে না। সন্তান প্রতিপালন মুখের কথা নয়। তার জন্য যথেষ্ট পরিকল্পনা দরকার। আর সেই পরিকল্পনা করতে গিয়েই বহু দম্পতি দেখছেন যে, যে অর্থ তাঁরা উপার্জন করেন তা হয়তো সন্তানকে মনের মতো মানুষ করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। সেদিক থেকে একরকমের অনিশ্চয়তা বোধ সম্ভবত তাঁদের মধ্যে কাজ করছে। তবে, এর বিকল্পও তাঁরা খুঁজে নিচ্ছেন। এক্ষেত্রে তাঁদের পছন্দ হচ্ছে পোষ্য। কেন? বিশ্লেষকরা বলছেন, পোষ্যপালনের মধ্যেও দায়িত্ববোধ আছে। আবার একরকমের সন্তানসুখের সন্ধানও আছে। তবে, সন্তান প্রতিপালনের নিরিখে দেখতে গেলে, দুই ক্ষেত্রেই তা অনেকটা কম। অর্থাৎ তুলনামূলক ভাবে এটি একটি সহজ উপায়। যেখানে খরচখরচা সামলেও নিজেদের আবেগের জায়গাটাও বজায় রাখা যাচ্ছে।
আরও শুনুন: গায়ে রাজনীতির ছাপ নেই, তবু ভোট যুদ্ধে নয়া ভরসা হয়ে উঠছেন ইনফ্লুয়েন্সাররাই?
আর একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে জীবনশৈলীর বদল। কেরিয়ার এখন মানুষের জীবন থেকে যে সময় কেড়ে নিচ্ছে, সন্তানকে মানুষ করার ক্ষেত্রে তা বড় প্রতিবন্ধক। দুই দিক বজায় রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পোষ্যের ক্ষেত্রে সেই সমস্যা নেই। কেরিয়ারে যতটা সময়ই দেওয়া হোক না কেন, পোষ্যের তাতে কোনও আপত্তি নেই। সেদিক থেকে অপরাধবোধেরও কোনও জায়গা নেই। বর্তমান জীবনধারাতে কেরিয়ার, ভ্রমণ ও অন্যান্য বিষয়গুলি যেভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে, এই সিদ্ধান্তের দরুণ তা-ও ব্যাহত হচ্ছে না। যেমন, সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা বলছে, বেশিরভাগ তরুণ দম্পতি অবসরের ভাবনার থেকেও ভ্রমণের পরিকল্পনাকে বেশি গুরুত্ব দেন। অর্থাৎ জীবনের বর্তমান অভিজ্ঞতা তাঁদের কাছে অনেক দামি। স্পষ্টই পুরনো ধারণা থেকে তাঁরা অনেকাংশে সরে এসেছেন। এই বদলের মধ্যে সন্তান ধারণ এবং পালনকে আর তাই তাঁরা জায়গা দিচ্ছেন না। বরং অপত্যের যে অভাব, সেখানেই ‘থেরাপি’ হয়ে দেখা দিচ্ছে পোষ্যের আদর। আর তাই গোটা বিশ্বেই এই DINK দম্পতির সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে।
তবে, বিশ্লেষকদের মতে, এই সিদ্ধান্ত সমাজের মন ও মনস্তত্ত্ব বদলের একটি বাইরের চিহ্নমাত্র। কয়েকটি কারণ দিয়ে তার ব্যাখ্যা মেলে না। অর্থনৈতিক, সামাজিক নানা পরিস্থিতি, সেই হেতু বদলে যাওয়া জীবনই ক্রমশ এই সিদ্ধান্তকে স্বাভাবিক করে তুলেছে। ফলত পরিবারের চিরায়ত ধারণাতেও বদল আসছে অনেক। আর তাই, এই সিদ্ধান্তটিকে আরও খতিয়ে দেখার প্রয়োজন আছে বলেই মনে করছেন তাঁরা।