‘এমন যদি হত/ আমি পাখির মতো/ উড়ে উড়ে বেড়াই সারাক্ষণ’… এমন কথা কে না ভাবি আমরা! তবে পাখির মতো ডানা মেলে উড়তে না পারলেও পাখির ভাষাতেই কিন্তু কথা বলেন এই পৃথিবীর কিছু মানুষ। কারা তাঁরা? সেই ভাষাই বা কেমন? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
বঙ্গদেশের মানুষ পাখির ভাষায় কথা বলে। সে ভাষার চেয়ে মিষ্টি ভাষা পৃথিবীতে নেই।- তাঁর এক চরিত্রকে দিয়ে এমন কথাই বলিয়েছিলেন ব্যোমকেশের স্রষ্টা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে আলংকারিক অর্থে নয়, সত্যি সত্যিই পাখির ভাষায় কথা বলা মানুষের দেখা মেলে এই পৃথিবীতে। পাখির মতোই শিস দিয়ে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তাঁরা। আজকালের কথা নয়, এই ভাষায় কথা বলা মানুষের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন খোদ গ্রিক পরিব্রাজক হেরোডোটাস-ও। হাজার হাজার বছর পরেও সে ভাষা পুরোপুরি মরে যায়নি। তুরস্ক, স্পেন, গ্রিসের প্রত্যন্ত কিছু অঞ্চলে আজও কালের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে পাখির ভাষা।
আরও শুনুন: অনন্য স্বীকৃতি, আফ্রিকার এক দেশেও সরকারি ভাষার মর্যাদা পেয়েছে বাংলা
ভাবছেন, কেমন সেই ভাষা? সে ভাষায় অক্ষর নেই, শব্দ নেই, বাক্য নেই। আছে কেবল শিস। কিন্তু তা কেবল বিচ্ছিন্ন কিছু আওয়াজ মাত্র নয়। এইসব শিস রীতিমতো অর্থ বহন করে। আসলে অনেক দূর থেকে কথা শোনা না গেলেও শিসের আওয়াজ আমাদের কানে পৌঁছায়। এমনকি ৪ কিলোমিটার অবধি নাকি পৌঁছাতে পারে এই আওয়াজ। তাই যেসব অঞ্চলে মাইলের পর মাইল জুড়ে ছড়িয়ে আছে খেত, সেখানকার মানুষেরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের সুবিধার জন্য শিস দিয়ে ভাবপ্রকাশ করত। মরক্কোর অ্যাটলাস, হিমালয়ের পার্বত্য জনপদ, লাওসের মালভূমি, ব্রাজিলের আমাজন অববাহিকা, খরাপীড়িত ইথিওপিয়াতে একটি দুটি নয়, গোটা পৃথিবীতে প্রায় ৭০টি শিসভাষা নথিভুক্ত আছে। নির্দিষ্ট কাঠামোও রয়েছে এই ভাষাগুলির। এমনকি ইউনেস্কোর হেরিটেজ তালিকাতেও স্বীকৃতি পেয়েছে দু-দুটি শিসভাষা। স্পেনের ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জের লা গোমেরোতে প্রচলিত সিলবো গামেরো ইউনেস্কো স্বীকৃতি পেয়েছে ২০০৯ সালে, আর ২০১৭ সালে এই স্বীকৃতি লাভ করেছে তুরস্কের পাখিভাষা কুসদিলি।
আরও শুনুন: মুক্তিযুদ্ধের দরুন পাওয়া গেল ORS, বিশ শতকের সেরা আবিষ্কারের কৃতিত্ব তিন বাঙালির
‘কুসদিলি’ শব্দের অর্থই হল পাখির ভাষা। এটি মূলত তুর্কি ভাষারই সাংকেতিক রূপ। এখন কেবল তুরস্কের কুস্কয় গ্রামেই এই ভাষা শোনা যায়। ২০১৪ সাল থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়েও ভাষাটি শেখানো হচ্ছে। একই উপায়ে সিলবো-কে বাঁচিয়ে রেখেছে স্পেনের দ্বীপটিও। ১৯৯৯ সাল থেকে এখানকার বিদ্যালয়ে অবশ্যপাঠ্য করা হয়েছে এই শিসভাষাকে। বিশাল দ্বীপে সমুদ্রের হাওয়ার আওয়াজের মধ্যে কথা শোনা যায় না। সেই কারণেই সিলবো-র উৎপত্তি হয়েছিল। প্রায় তিন কিলোমিটার দূরেও যোগাযোগ করতে পারত সিলবাদর, অর্থাৎ সিলবোভাষীরা।
মধ্য গ্রিসের ইউবিয়ার আন্তিয়া গ্রামের বাসিন্দারাও একরকম শিসভাষায় কথা বলে থাকেন। এর আঞ্চলিক নাম স্ফিরিয়া, যার উৎপত্তি গ্রিক শব্দ ‘স্ফিরিজো’, অর্থাৎ শিস দেওয়া থেকে। এটিও মূলত গ্রিক ভাষারই সাংকেতিক রূপ। তবে রক্ষণশীল স্ফিরিয়াভাষীরা ভুলেও প্রেম সংক্রান্ত কোনও কথা বলেন না এই ভাষায়। রক্ষণশীলতার কারণেই এই ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ইউনেস্কোর কাছে কোনোরকম আবেদনও করেননি তাঁরা। ফলে বর্তমানে মাত্র জনা কুড়ি লোক এই বিলুপ্তপ্রায় ভাষায় কথা বলেন।
জার্মানির বোকমের ইনস্টিটিউট অব কগনিটিভ নিউরোসায়েন্সের এক গবেষণা জানিয়েছিল, আমাদের মস্তিষ্কের বাঁ পাশ ভাষার অর্থ বুঝতে পারে। আর ডান পাশে রয়েছে সুর-তালের অনুভূতি। তাই ব্রেন স্ট্রোক জাতীয় কোনও কারণে কারও মস্তিষ্কের বাঁ পাশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার ভাব প্রকাশে সাহায্য করতে পারে এই পাখির ভাষা, এমনই দাবি করেছে ওই গবেষণাপত্র।