দীপাবলিতে কারও পৌষমাস তো কারও সর্বনাশ। বাজির আনন্দে যখন মানুষ মশগুল, তখন বাজির শব্দে কাতর পোষ্যরা, বিশেষত কুকুর। পুরো উৎসবটাই তাদের কাছে ভয়ের আবহ তৈরি করে। কিন্তু কেনই বা এই আওয়াজে এত বিপাকে পড়ে তারা? এক্ষেত্রে মানুষের কী করণীয়?
উৎসবে একজনের আনন্দ যেন অন্যের দুঃখের কারণ না হয়ে দাঁড়ায়। এ-কথা আমরা প্রায়শই বলে থাকি। তবে তা কিন্তু শুধু মানুষের জন্য প্রযোজ্য নয়। মানুষ যেমন একে অন্যের খেয়াল রাখবে, উৎসব যাতে সকলের কাছে আনন্দময় হয়ে ওঠে সে বিষয়ে নজর রাখবে, তেমনই মানুষের খেয়াল রাখা উচিত যে, নিজেদের আনন্দ যেন মনুষ্যেতর প্রাণীদের দুঃখের কারণ না হয়ে দাঁড়ায়। অথচ আমরা তা ভুলে যাই। দেদার শব্দবাজির দৌরাত্ম্য ঢেকে দেয় উৎসবের বাতাস। আর তাতেই বেজায় বিপাকে পড়ে প্রাণীকুল। বিশেষত পোষ্য কুকুররা তো এই শব্দের প্রভাবে ভীষণই অসুবিধায় পড়ে।
কুকুরদের শ্রবণশক্তি যে প্রখর, তা আমরা জানি। অনেকটা দূর থেকে মৃদু কোনও আওয়াজও তারা সহজেই শুনতে পায়। এই শ্রবণশক্তির কারণেই বাজির আওয়াজ তাদের কাছে ভয়াবহ হয়ে ওঠে। শব্দবাজির প্রাবল্য ঠিক কোনদিন হবে, সে বিষয়ে মানুষ নিজেকে তৈরি করে রাখে। কিন্তু কুকুরদের কাছে তা একেবারেই অজানা। অকস্মাৎ ঘনঘন এই বিষম আওয়াজে তারা ভয়ার্ত হয়ে পড়ে। খেয়াল করে দেখা গিয়েছে, এই আওয়াজ তাদের এতটাই ভীত করে তোলে যে কুকুররা প্রায় বিকারগ্রস্তের মতো আচরণ করে। এমনকি যে কুকুর সাধারণত কাউকে কামড়ায় না, সে-ও কামড় দিতে উদ্যত হয়। নিজের মালিককে পর্যন্ত কামড়ে ফেলে তারা। ভয়ে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়েই এহেন কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলে সারমেয়রা।
আরও শুনুন: দীপাবলিতে বাজির রমরমা, দূষণ থেকে বাঁচাতে ভরসা রাখুন ভেষজেই
তবে তাদের এই আচরণ কিন্তু অযৌক্তিক নয়। শব্দের সঙ্গে কুকুরের এই ভীত হয়ে ওঠার প্রবণতার সম্পর্ক খতিয়ে দেখেছেন বিজ্ঞানীরা। প্রচণ্ড শব্দের কারণে কুকুররা এক ধরনের ট্রমাটিক পরিস্থিতিতে চলে যায়। তার অনেকরকম কারণ থাকতে পারে। একটি পোষ্য কুকুর শব্দের প্রতি গোড়া থেকে কীভাবে প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে, তাঁর উপর অনেক কিছু নির্ভর করে। তবে এ বিষয়ে খুব একটা সচেতন আমরা হই না। দেখা যায়, শিকারী প্রজাতির কুকুররা শব্দের প্রাবল্য অনেকটা সামলে নেয়। আবার ক্রস-ব্রিড যারা, তারা ভীত হয় বেশি। অর্থাৎ শব্দ এক একটি কুকুরের কাছে কী অভিজ্ঞতা বা স্মৃতি বয়ে আনছে তার উপর ভিত্তি করে ভয়ের মাত্রা। তবে দেখা যায়, অধিকাংশ কুকুরই শব্দে ভয় পায়। পরবর্তী এক গবেষণা তাই জানাচ্ছে, বিষয়টি জেনেটিক। জিনগত কারণেই শব্দে ভয় পায় কুকুররা। প্রায় ১৭ প্রজাতির হাজার পাঁচেক কুকুরকে পর্যবেক্ষণ করেই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান বিজ্ঞানীরা।
আরও শুনুন: মা কালীর বিশেষ কয়েকটি রূপের পুজো করেন না গৃহস্থরা, নেপথ্যে শাস্ত্রের কোন কারণ?
ফলত শব্দের প্রাবল্যের সঙ্গে কুকুরের ভীত হওয়ার যে একটা সম্পর্ক আছে, তা মানুষের খেয়াল রাখা উচিত। আগাম প্রস্তুতিহীন আচমকা প্রচণ্ড শব্দে মানুষও যেমন ভয়ার্ত হয়ে ওঠে, তেমনই অবস্থা পোষ্যদেরও। শুধু কুকুরই নয় বিড়াল কিংবা গরুও এই শব্দের দৌরাত্ম্যে বিচলিত হয়ে ওঠে। সাধারণ ভাবে পরামর্শ দেওয়া হয় যে, পোষ্যকে এমন জায়গায় রাখতে হবে, যাতে এই শব্দের প্রাবল্য তার কাছে খানিকটা কম হয়। মালিকরা পোষ্যদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করুন যাতে এই ভয় থেকে তারা মুক্তি পায়, স্বস্তি বোধ করতে পারে। বা পোষ্যদের পছন্দের কাজে তাদের মাতিয়ে রাখলে এই ভয় থেকে খানিকটা দূরে থাকতে পারে তারা।
কিন্তু এগুলোই একমাত্র সমাধান নয়। সব কুকুর পোষ্য নয়। শব্দের কারণে বেজায় অস্বস্তিতে পড়ে পাড়ার শান্ত পথকুকুররাও। তারাও অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে। তাই সচেতন হওয়া উচিত মানুষেরই। উৎসবের দিনে সেই ক্লিশে কথাটিই মনে রাখা উচিত যে, একজনের আনন্দ যেন অন্যের দুঃখের কারণ না হয়। এমনকী তা মনুষ্যেতর প্রাণীর দুঃখ হলেও, উৎসবের সার্থকতা কিন্তু মাটিই হয়।