কথায় বলে, সব রাস্তাই নাকি যায় রোম পর্যন্ত। কিন্তু ধরুন যদি কোনও রাস্তাই না থাকে। অথচ সেখানে বাড়ি আছে, ঘর আছে। আছে মানুষের বসতিও। ভাবছেন তো, এমন আবার হয় নাকি! রাস্তা না থাকলে সেখানে মানুষ থাকবে কী করে? কিন্তু পৃথিবীতে রয়েছে এমনও গ্রাম, যেখানে খুঁজলেও মিলবে না কোনও রাস্তা। সেখানে সব রাস্তাই বন্ধ বলা যায়। এমন কি কোনওরকম গাড়িঘোড়ারও সেখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ। কোথায় রয়েছে এমন অদ্ভুত গ্রাম? আসুন, শুনে নিই।
যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকলে সেখানে জনবসতি থাকা সম্ভব নয়। তবে এই জায়গা তার ব্যতিক্রম। এখানে দিব্যি মানুষ রয়েছে, বসতি রয়েছে, রয়েছে দোকান-বাজার সমস্তটাই। তবে রাস্তা ব্যাপারটাই গায়েব। তবে কীভাবে নিত্যদিনের যাতায়াত সারেন এখানকার মানুষ?
না, পক্ষীরাজ ঘোড়া এঁদের নেই বটে। তবে রয়েছে জলযান। কারণ এখানকার সমস্ত পথই যে খালবিলে ভরা। সে পথেই নৌকো নিয়ে চলাফেরা করেন নিত্যযাত্রীরা।
আরও শুনুন: সময়ে-অসময়ে ভেসে আসে সুর, থেকে থেকে গান গেয়ে ওঠে ‘রহস্যময়’ সেতু!
ইউরোপের শহর নেদারল্যান্ডস। সেখানেই রয়েছে ছবির মতো সুন্দর একটা গ্রাম, যার নাম গিটহোর্ন। ওলন্দাজদের এই ছোট্ট গ্রামটিকে বলা হয় নেদারল্যান্ডের ভেনিস। ভেনিসের মতো গন্ডোলা না ভাসলেও এখানে যাতায়াতের একমাত্র সম্বল ওই নৌকা। এখানে কোনও রকম গাড়িঘোড়ারই নো এন্ট্রি। তবে হাল আমলে সাইকেল চলাচলের একটি ছোট্ট রাস্তা যোগ করা হয়েছে।
এ গ্রামে পৌঁছলে মনে হবে স্বপ্ন দেখছেন। নীল আকাশ, ছোট ছোট রঙিন বাড়ি গাছপালার ছায়ায় ঢাকা। বাড়ির সামনে কেয়ারি করা বাগান। তবে সবটাই জলে ঘেরা। নৌকার পাশাপাশি রয়েছে ছোট ছোট কাঠের সেতু। মোট ১৮০টি কাঠের ব্রিজ রয়েছে ছোট্ট গ্রামে। বাড়ি থেকে বাড়ি জুড়ে রাখে সেই সেতুই। তার মাধ্যমেও টুকটাক যাতায়াত সারেন স্থানীয়রা। তবে বেশি দূর যেতে হলে ভরসা নৌকাই।
কথিত আছে, ১১৭০ সাল নাগাদ বন্যায় ভেসে গিয়েছিল গোটা গ্রাম। মারা গিয়েছিল প্রচুর পশুপাখি। সে সময় সেখানকার একদল স্থানীয় কৃষক নাকি দেখতে পান এক পাল জংলি ছাগল প্রাণহীন হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। সেই ‘গোট হর্ন’ থেকেই নাকি পরে গ্রামের নাম হয় গিটহোর্ন।
সব মিলিয়ে ২৬০০ মানুষের বাস এই গ্রামে। এই স্বপ্নের মতো গ্রামকে একইরকম রাখতে একটা ধনুকভাঙা পণ নিয়ে বসেছেন এখানকার বাসিন্দারা। না, রাস্তা তাঁরা কিছুতেই হতে দেবেন না গিটহোর্নে। রাস্তা মানেই তো গাড়িঘোড়া, আর গাড়িঘোড়া মানেই দূষণ। তাই সেই সর্বনাশ থেকে গিটহোর্নকে দূরেই রাখতে চান সেখানকার মানুষ। তাছাড়া যোগাযোগহীনতাই এই গ্রামকে বানিয়ে তুলেছে এমন শান্ত, স্নিগ্ধ, উত্তেজনাহীন। এমনকি সে গ্রামে পোস্টম্যানকেও আসতে হয় দাঁড় ঠেলেই।
অপূর্ব নৈসর্গ, জলপথ ছাড়াও আরেকটা জিনিস দেখার রয়েছে এই গ্রামে। বেশ কয়েকটা মিউজিয়াম রয়েছে গিটহোর্নে। এখানকার মানুষ অতীতচারী। ইতিহাসকে কীভাবে বাঁচিয়ে রাখতে হয়, তা তাঁরা জানেন। প্রতিবছর নানা ধরনের প্রদর্শনীর আয়োজন করে মিউজিয়ামগুলি। সেখানে অংশ নেন বহু মানুষ।
আরও শুনুন: মাটির নিচে বাড়িঘর, রেস্তরাঁ, এমনকী ফুটবল ক্লাবও! কোথায় রয়েছে এমন পাতাল-শহর?
শীতের দিনে বরফে ঢেকে যায় ছোট কাঠের সেতুগুলো। বাড়ির চালে লেগে থাকে বরফের কুচি। দূর থেকে দেখলে তখন গ্রামটাকে সান্টার বাড়ি বলেই মনে হয়। গ্রামে রয়েছে বেশ কয়েকটি ছোট বড় রেস্তরাঁ। যেখানে মেলে স্থানীয় খাবার। শীতের বিকেলে সেই রেস্তরাঁয় বসে স্থানীয় খাবারের স্বাদ নেওয়ার মজাটাই নাকি আলাদা। পর্যটকদের গ্রাম ঘুরে দেখার জন্য রয়েছে বিশেষ নৌকোর ব্যবস্থাও। সব মিলিয়ে পর্যটকদের কাছে এই ছোট্ট ভেনিসের আকর্ষণ হয়ে উঠেছে অমোঘ। সান্টার বাড়ি দেখার ইচ্ছা থাকলে এই স্বপ্নের গ্রাম থেকে কিন্তু ঘুরে আসতে পারেন আপনিও।