মৃতদেহের সঙ্গে ছবি! ব্যাপারটা ভাবলে হয়তো অনেকেরই অস্বস্তি হবে। তবে এখনও বহু জায়গাতেই মৃতদেহের সঙ্গে শেষ ছবি নিজেদের সংগ্রহে রাখতে চান নিকট আত্মীয়রা। তাই ওই শোকের মধ্যেও সেখানে হাজির করা হয় রীতিমতো পেশাদার ফটোগ্রাফার। মৃতদেহের সঙ্গে ছবি তোলার এই রীতি কোথা থেকে শুরু হল জানেন? আসুন, শুনে নেওয়া যাক সেই গল্পই।
প্রিয়জন বা কাছের মানুষের মৃত্যু আমাদের সব সময়ই কষ্ট দেয়। চলে যাওয়া মানুষের স্মৃতি সিন্দুকে জমিয়ে রাখে লোকে। তাঁর ব্যবহারের জিনিস, তাঁর ছবি, তাঁর দেওয়া উপহার সমস্ত কিছু বারবার মনে করিয়ে দেয় সেই মানুষটার কথা। তাঁর সঙ্গে কাটানো সুখস্মৃতিকেই যত্নে রাখতে চায় মানুষ। তবে হৃদয় খুঁড়ে কজনই বা বেদনা জাগাতে চায় বলুন তো? মৃত্যুও তো তেমনই এক বিচ্ছেদ-মুহূর্ত, যা মানুষকে কষ্টে জর্জরিত করে। তা সত্ত্বেও সেই খারাপ মুহূর্তকেও ক্যামেরাবন্দি করে রাখতে চায় অনেকেই। খুব বেশিদিন আগেকার কথা নয়। মৃতদেহের সঙ্গে ছবি তুলতে রীতিমতো ক্যামেরাম্যান ডাকার রেওয়াজ ছিল। এখনও বহু জায়গাতেই মানা হয় সেই প্রথা। রাখা হয় মৃতের পায়ের ছাপও। কখনও ভেবে দেখেছেন, কেন প্রিয়জনের মৃতদেহ, বিকৃত মুখের ছবি মানুষ সযত্নে রেখে দেয় নিজের কাছে? কবে থেকে শুরু হল এই রেওয়াজ?
আরও শুনুন: আজগুবি নয়, সত্যি! যাঁর শোকসভা আচমকা কথা বলে উঠলেন সেই বৃদ্ধা, তারপর?
ইতিহাস অবশ্য জানাচ্ছে এ প্রথা আজকের নয়। সেই ভিক্টোরিয়ান যুগ থেকেই মৃতদেহের ছবি জমিয়ে রাখতে শুরু করেছিল মানুষ। কেউ কেউ আবার সেটাকে বলতেন পোস্টমর্টেম ফোটোগ্রাফি। মার্কিন ও ইউরোপ, দু’দেশের সংস্কৃতিতেই চল ছিল মৃতদেহের ছবি সংরক্ষণের। সেটার একটা কারণ তো অবশ্যই স্মৃতিটুকু আগলে রাখা। তবে অন্য একটা দিকও নাকি থাকত এই ছবি তোলার পিছনে। ওই ছবি নাকি আত্মীয়, পরিজনেদের শোকের সঙ্গে যুঝতে সাহায্য করত অনেকটাই। কখনও কখনও এমনটাও হত, মৃত্যু-মুহূর্তের ওই ছবিটুকুই প্রিয়জনেদের কাছে থাকা একমাত্র ছবি। নিউ হ্যাম্পশায়ারে যেমন এক সদ্যোজাতের মৃতদেহের ছবিই ছিল তাঁর বাবা-মায়ের কাছে একমাত্র সান্ত্বনা। আসলে সে সময় শিশুমৃত্যু ছিল খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। নানাবিধ রোগ, চিকিৎসার অভাব-সহ নানা সমস্যায় প্রায়শই বাঁচানো যেত না সদ্যোজাতদের। তাদের স্মৃতিটুকু ওই ভাবেই আগলে রাখতেন পরিবারের লোকেরা।
এখন আমাদের হাতের মুঠোয় ক্যামেরা। প্রায় প্রতিটা মুহূর্তকেই ক্যামেরাবন্দি করে রাখার চেষ্টা চলে অনবরত। তবে বছর তিরিশেক আগেও মোবাইলের চল ছিল না তেমন। ক্যামেরা ব্যাপারটাতেও তেমন সড়গড় ছিল না মানুষ। পাড়ার মোড়ের একটা-দুটো স্টুডিওই ছিল এসব ক্ষেত্রে শেষ কথা। তবে তারও অনেক আগে, ১৮৩৯ সাল নাগাদ বাণিজ্যিক ভাবে আত্মপ্রকাশ করল দাগেরোটাইপ ফটোগ্রাফি। তার আগে ছবি তোলার ব্যাপারে বিশেষ কিছু জানতই না সাধারণ লোকে। সেই দাগোরোটাইপ ক্যামেরার মাধ্যমেই প্রথম ছবির মাধ্যমে স্মৃতি জমিয়ে রাখতে শিখল তাঁরা। শুরু হল বিচ্ছেদের মুহূর্তকেও স্মরণীয় করে রাখার চেষ্টা। আসলে গোটা পরিবারকে তো আর সচরাচর একসঙ্গে একফ্রেমে পাওয়া যেত না। তবে পরিজনের মৃত্যু হলে শেষবারের মতো চোখের দেখা দেখতে দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসতেন আত্মীয়, পরিজনেরা। আর সেই মুহূর্তটাকেই ধরে রাখা হত পোস্টমর্টেম ফোটোগ্রাফির মাধ্যমে। ফলে খানিকটা নথি হয়েই থেকে যেত সেই ছবি।
আরও শুনুন: বিখ্যাত মানুষের সমাধি দেখাই নেশা, অদ্ভুত শখে বিশ্বভ্রমণ ব্যক্তির
অনেক জায়গায় আবার মৃতদেহের মুখের ছাঁচ নিয়ে নেওয়ারও চল ছিল। তাকে বলা হত ‘ডেথ মাস্ক’। আফ্রিকা ও মিশরেই প্রথম চালু হয়েছিল সেই রীতি। তাঁর সঙ্গে মিশে ছিল তাঁদের বিশ্বাস ও কিছু আচার। সেই ছাঁচের আদলে অনেক সময়ই মোম, প্লাস্টার কিংবা ক্লে-কাস্ট দিয়ে বানানো হত মৃত মানুষটির মূর্তি। আসলে ফটোগ্রাফি আবিষ্কার হওয়ার আগে এটাই ছিল মৃত ব্যক্তির চেহারা মনে রাখার একমাত্র প্রামাণ্য উপায়। এমনকি পুলিশি কাজেও ব্যবহৃত হত এমন ছাঁচই। শুধু মুখেরই নয়, প্রয়োজন বুঝে শরীরের বিভিন্ন অংশেরও ছাঁচ সংরক্ষণ করত পুলিশ। তবে ক্যামেরা আবিষ্কার হওয়ার পরে সেই হ্যাপা কমল। মৃতদেহের ছবি তোলার সব চেয়ে সহজ পদ্ধতি ছিল, শায়িত অবস্থায় দেহের ছবি তোলা। কখনও কখনও পরিজনেরা আবার চাইতেন ছবিটি হোক একেবারে জ্যান্ত। যেন তাঁদের সঙ্গেই বসে রয়েছেন প্রিয়জন। সেক্ষেত্রে ধরেবেঁধে মৃতদেহটিকে বসানো হত চেয়ারে। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলত গোটা পরিবার। ছবিটি কতটা জ্যান্ত হত, তা বলা মুশকিল। তবে পরিবারের কাছে স্মৃতিচিহ্ন হয়ে থেকে যেত ছবিখানা। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা শুনতে অস্বস্তিকর হলেও একসময় কিন্তু আত্মীয় পরিজনদের কাছে সেই ছবির গুরুত্ব ছিল অনেকটাই।