‘যুদ্ধ মানে শত্রু শত্রু খেলা’। তা জানার পরেও প্রতিবেশী দেশের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয় তুলনায় শক্তিশালী কোনও দেশ। বোমা হানে, পাঠায় সৈন্য। আকাশে চক্কর কাটে যুদ্ধবিমান। এক লহমায় শান্ত স্নিগ্ধ শহরগুলি পরিণত হতে থাকে শ্মশানে। ঘরদোর, দেশ ছেড়ে পালায় একের পর এক মানুষ। সবশেষে কী পড়ে থাকে? পড়ে থাকে কেবল যুদ্ধের স্মৃতি। আর সেই স্মৃতি জড়ো করেই সম্প্রতি একটি প্রদর্শনী আয়োজিত হল যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনের রাজধানীতে। কী কী ছিল সেই প্রদর্শনীতে? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
এর আগেও যুদ্ধ দেখেছে এ দেশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি বুকে নিয়ে আজও সেখানে দাঁড়িয়ে আস্ত একটি মিউজিয়াম। যে সব যুদ্ধের গল্প, ইতিহাস এতদিন ছবিতে দেখা, বইয়ে পড়া কিংবা মিউজিয়ামের জিনিসপত্রে আটকে ছিল, তা যেন হঠাৎ করে বইয়ের পাতা থেকে ছিটকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল চোখের সামনে।
হঠাৎ করেই ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করে দিল রাশিয়া। তার পর থেকেই গোলাগুলি, বোমা। ইউক্রেনের একের পর এক শহরে রুশ সেনার টহল আর প্রাণভয়ে ট্যাঙ্কারে লুকিয়ে থাকা অসংখ্য অনিশ্চিত জীবন। এই বুঝে বুলেট এসে ঝাঁঝড়া করে দিয়ে গেল বুক। রাতের অন্ধকারে শহর গুড়িয়ে দিয়ে গেল বোমারু বিমান। আর এত কিছু সামলে যারা বেঁচে রইলেন, রাতের অন্ধকারে প্রাণ হাতে করে দেশ ছাড়তে হল তাঁদের। তার পরের গল্পটা সকলের জানা। একের পর এক প্রতিবেশী দেশের সীমান্তে উপচে পড়া ভিড়, শরণার্থী স্রোত। এ সমস্ত কিছুই খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছে ইউক্রেন।
যুদ্ধ পুরোপুরি না থামলেও তার তীব্রতা কমেছে। বেশ কিছু শহরের দখল নিয়েছে রুশ সেনা। আবার কিছু কিছু শহরে শত্রুসেনাকে রুখে দিয়েছে ইউক্রেন। কোন কিছুর বিনিময়েই হাতছাড়া করেনি নিজেদের স্বদেশ, রাজধানী। কিছুদিন আগে পর্যন্ত কিয়েভের রাস্তায় টহল দিয়েছে রুশ বাহিনী। সম্প্রতি সেখান থেকে সেনা সরাতে শুরু করে মস্কো।
আরও শুনুন: কয়েকশো পোষ্যের ভার তাঁরই কাঁধে! তাদের মুখ চেয়েই যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন ছাড়তে নারাজ বৃদ্ধা
তাতে কী! এখনও সেখানে চাঙ্গা যুদ্ধের স্মৃতি। বুলেটের শেল, বোমার টুকরো, মিসাইল ভাঙা কাচ থেকে শুরু করে ধুলোয় মিশে যাওয়া বাড়িঘরের ধ্বংসাবশেষ, হেলমেট- সে সমস্ত কিছুই কুড়িয়ে আনা হয়েছে। সে সব কুড়ানো যুদ্ধের স্মৃতি নিয়েই সম্প্রতি একটি প্রদর্শনী হয়ে গেল কিয়েভের ‘ওয়ার্ল্ড ওয়ার টু’ মিউজিয়ামে।
ধ্বংসাবশেষের পাশাপাশি সেই প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে নিহত রুশ সেনাদের লেখা শেষ চিঠি, ক্রেডিট কার্ড থেকে শুরু করে আরও অনেক কিছুই। রয়েছে তাঁদের পাসপোর্টও। রয়েছে স্যুপের জার থেকে শুরু করে এমন নানা অনুষঙ্গ। কিয়েভের বিমানবন্দরের কাছে এই অস্থায়ী শিবির তৈরি করা হয়েছিল যুদ্ধের সময়। সেখানে ৩৭ দিন পর্যন্ত প্রচুর মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন। ছিলেন শিশু থেকে বুড়ো অনেকেই। অস্বাস্থ্যকর ওই পরিবেশে প্রাণও হারান দুজন। সেই অস্থায়ী শিবিরের চিহ্নগুলিকেও স্থান দেওয়া হয়েছে ওই মিউজিয়ামে। রয়েছে এমন কিছু চিত্র ও স্থাপত্য, যা আসলে ওই যুদ্ধের ফসল। ইউক্রেন-রাশিয়ার এই যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে অসংখ্য শিশু। আর সেই প্রমাণই ধরা রয়েছে খেলনা আর পুতুলের মধ্যে লুকানো গ্রেনেডের অনুষঙ্গে। সেই গল্পও বলবে ওই প্রদর্শনী।
আরও শুনুন: যুদ্ধে পা হারিয়েও হারাননি মনোবল, বিয়ের অনুষ্ঠানে নেচে নজর কাড়লেন ইউক্রেনের নার্স
মিউজিয়ামটির কিউরেটর ইউরিয়ে সাভাচুক জানালেন, যে ধরনের ফ্যাসিজমের সঙ্গে লড়াই করেছে ইউক্রেন, তারই প্রমাণ এগুলো। এসবকে ছুঁয়ে সেই যুদ্ধক্লান্ত দিনগুলির ইতিহাসকে ফের ছুঁয়ে দেখতে চান ইউক্রেনবাসী।
তবে সত্যিই কি ভয়ঙ্কর সেসব দিনগুলির কথা মনে করতে চান মানুষ? উঠেছে প্রশ্ন। ২৬ বছরের এক তরুণী জানালেন, ইউক্রেনে থাকলেও তাঁদের গ্রামে তেমন যুদ্ধের আঁচ পৌঁছয়নি। রুশ সেনার টহল দেখেননি তিনি। ইউক্রেনের অধিকাংশ মানুষ যে লড়াই করেছেন, এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে তাকে ছুঁয়ে দেখতে পারছেন তার মতো আরও অনেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন বুকে নিয়ে এতদিন ঠায় দাঁড়িয়েছিল সেই মিউজিয়াম। এবার তার বুকে যোগ করা হল সাম্প্রতিকতম যুদ্ধের টাটকা স্মৃতিও। মিউজিয়াম তো একরকম ভাবে স্মৃতির সফরই। আর সেই ভয়ঙ্কর যুদ্ধের স্মৃতি ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য যত্ন করে তুলে রাখছে সেই মিউজিয়াম।