বিশেষ কোনও খাবার, অচেনা সংস্কৃতি এবং কোনও বিশেষ পুজো ঘিরে বিখ্যাত হয় কিছু জায়গা। বিখ্যাত মানুষদের জন্মস্থানও বিশেষভাবে পরিচিতি পায় তাঁদের নামে। কিন্তু দেশের এই গ্রাম দাবা খেলার জন্য বিখ্যাত। মানে এই গ্রামের সবাই দাবা খেলার সঙ্গে যুক্ত। কোথায় রয়েছে এমন গ্রাম? আসুন শুনে নিই।
কথায় আছে, তাস, দাবা, পাশা তিন সর্বনাশা। যদিও দক্ষিণের এক গ্রামের বাসিন্দারা এমনটা একেবারেই মনে করেন না। গ্রামে প্রায় সব বাসিন্দারই রয়েছে দাবা খেলার নেশা। আর এই নেশা তাঁদের জীবনে সর্বনাশ নয়, পৌষমাস এনেছে।
কথা বলছি, কারালার ত্রিশূর জেলার এক শান্ত সুন্দর গ্রাম মারোত্তিচাল সম্পর্কে। এমনিতেই কেরালা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। এই গ্রামও তার ব্যতিক্রম নয়। পাহাড়, ঝরনা, বড় বড় গাছ সব মিলিয়ে চারপাশটা ছবির মতো। তবে সেই কারণে এই গ্রাম বিখ্যাত নয়। গ্রামের পরিচিতির নেপথ্যে রয়েছে দাবা খেলা। ভাবছেন তো, এই গ্রাম নিশ্চয়ই নাম করা কোনও দাবাড়ুর জন্মভূমি। একেবারেই না। বরং এই গ্রামের সব বাসিন্দাকেই দাবাড়ু বলা চলে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এমন রেওয়াজ মারোত্তিচাল গ্রামে?
আরও শুনুন :
রামের মঙ্গলকামনায় পুজো দেবেন মদ ও মাংস দিয়ে, গঙ্গার কাছে মানত সীতার
তাহলে খুলেই বলা যাক। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে বরাবরই কেরালার এই গ্রামে পর্যটকদের আনাগোনা। পাহাড়ি রাস্তায় ট্রেকিং-এর জন্য একসময় এই গ্রামে ভিড় লেগেই থাকত। এরকম এক পরিবেশে হঠাৎ করে হানা দেয় মাদকের নেশা। অদ্ভুতভাবে গ্রামের যুবকদের মধ্যে নেশার ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ে মারাত্মক হারে। মদ, বিড়ি, সিগারেট কিছুই বাদ যেত না। সেইসময় পর্যটকদের কাছেও এই গ্রাম নেশার আখড়া হিসেবে পরিচিতি পেত। অনেকে এখানে আসতেন স্রেফ নেশার লোভে। এমনটা তো আর মেনে নেওয়া যায় না! বিশেষ করে, মারোত্তিচালে মতো সুন্দর গ্রামের পরিচয় এমন হওয়া মোটেও কাম্য নয়। প্রথমে মাঠে নামে স্থানীয় প্রশাসন। নেশা বন্ধের উদ্যোগে শুরু হয় ধরপাকড়। শাস্তি দেওয়া। কিন্তু কিছুতেই তেমন কাজ হয়নি। সেই সময় এগিয়ে আসেন সি উন্নিকৃষ্ণন নামে এক চা বিক্রেতা। ওই গ্রামেই তাঁর চায়ের দোকান। যার আশেপাশে রোজকার আড্ডা বসাত নেশাড়ু যুবকের দলবল। এতে গ্রামের নাম যেমন খারাপ হচ্ছিল, তেমনই গ্রামের অন্দরের পরিবেশও একেবারে নষ্ট হওয়ার জোগাড় হয়েছিল। এই আবহে উন্নিকৃষ্ণণ ঠিক করেন সবাইকে দাবা শেখাবেন। প্রথমে অবশ্য গুটিকয়েক বৃদ্ধ এতে আগ্রহ দেখান। এরপর এগিয়ে আসে খুদের দল। ধীরে ধীরে দেখা যায়, গ্রামে যারা নেশা করত না, তাঁদের সকলের মধ্যে অন্য নেশা ছড়িয়েছে কয়েক দিনে। সবাই নিয়ম করে দাবা খেলা শুরু করেছে। সেইসঙ্গে দাবা নিয়ে জোর কদমে আলোচনা চলতে থাকে। এঁদের দেখে নেশাড়ুদের মধ্যেও কয়েকজন এগিয়ে আসে দাবা খেলবে বলে। কৃষ্ণণ আসলে এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিলেন। যত্ন নিয়ে তাঁদের দাবা খেলা শেখান। ব্যাস তারপর আর কি, ম্যাজিকের মতো তাঁরাও যোগ দেয় দাবা খেলায়। ক্রমে বদলাতে থাকে পরিস্থিতি। নতুন নেশা ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে। তা অবশ্য কারও ক্ষতি করে না। সবাই দাবা খেলায় বুঁদ হতে শুরু করেন।
একটা সময়ের পর গ্রামের পরিচয় বদলে হয়ে যায় দাবার গ্রাম। এখনও তা অটুট রয়েছে। বর্তমানে গ্রামের বাসিন্দার সংখ্যা প্রায় ৬০০০। প্রতি পরিবার থেকেই অন্তত একজন দাবা খেলার সঙ্গে যুক্ত। পর্যটকরাও আজকাল সেখানে গিয়ে দাবার চাল দিতে বসে যান। নেশার কোনও নাম গন্ধ নেই। স্থানীয়রাও মারোত্তিচালের আসল নাম প্রায় ভুলতে বসেছেন। কেরালা পৌঁছে দাবাগ্রাম বললেই যে কেউ পৌঁছে দেবে এই গ্রামে।