সবুজে ঘেরা ঘন গাছপালার জঙ্গল তো আকছার দেখি আমরা। তার সৌন্দর্যও মনকাড়া। কিন্তু পাথরের জঙ্গল দেখেছেন কখনও। তবে দূর থেকে অবিকল গাছপালায় ঢাকা জঙ্গল বলেই ভুল হবে। কাছে গেলে দেখবেন, সবুজের চিহ্নমাত্র নেই। মাইলের পর মাইল জুড়ে অবিকল গাছেদের মতোই আকাশের দিকে মাথা বাড়িয়ে দিয়েছে পাথরের মহীরুহ সব। সত্যিই প্রাকৃতিক ভাবে এক মহাশ্চর্য চিনের এই পাথরের জঙ্গল। শুনে নিন।
দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর। কিন্তু এ কেমন অরণ্য, যা নগরের চেয়েও ভয়াবহ। এই জঙ্গলে সবুজের চিহ্নমাত্র নেই। না আছে লম্বা লম্বা গাছ, না আছে ফুলের মেলা, না পাখির ডাকাডাকি। তবু প্রায় তিনশো বর্গকিলোমিটার জায়গা জুড়ে এখানে ছড়িয়ে রয়েছে সুবিশাল জঙ্গল।
গাছ তেমন নেই বটে। তবে গাছের বদলে জায়গা করে নিয়েছে পাথরের বৃক্ষেরা। ঠিকই শুনেছেন। অবিকল গাছের মতোই মাথা সোজা করে এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে পাথরের জঙ্গল।
চিনের হুনান প্রদেশের কুনমিং শহর। সেখানেই রয়েছে স্টোন ফরেস্ট বা পাথুরে জঙ্গল। পৃথিবীর অন্যতম আশ্চর্যজনক জায়গাগুলির মধ্যে একটি এই জায়গা। রাতারাতি যে এই জঙ্গল তৈরি হয়েছে, তেমনটা কিন্তু নয়। প্রায় ২৭ কোটি বছর লেগেছে আজকের এই জায়গায় পৌঁছতে। ২০০৭ সালে ইউনেস্কোর ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটে’র মর্যাদা পায় চিনের এই পাথরের জঙ্গল শিলিন।
আরও শুনুন: গেছো ছাগল বলে কথা! মগডালে চড়ে খোশমেজাজে ছাগলের দল, দেখতে ভিড় পর্যটকদের
গাছ না হয় বড় হয়, ডালপালা মেলে জঙ্গলের আকার নেয়। কিন্তু পাথর! সে কি করে বড় হবে, বুড়ো হবে। যদি না-ই হবে, তবে কী ভাবে এত বছর ধরে তৈরি হল সুবিশাল এই পাথরের জঙ্গল। না, কোনও ম্যাজিক নয়। এ আসলে বিশুদ্ধ প্রকৃতির খেলা।
বহু বছর ধরে সমুদ্রের তলায় জমা হয়েছিল চুনাপাথর। ভূতাত্ত্বিকরা মনে করেন, কার্স্ট টোপোগ্রাফির অন্যতম উদাহরণ এই পাথুরে জঙ্গল। বড় কোনও ভূমিকম্প বা অন্য কোনও কারণে ভৌগোলিক ভাবে পালটে গিয়েছিল এই অঞ্চল। আজ যেখানে পাথরের অরণ্য, মনে করা হয়, কোনও এককালে সেখানে ছিল সমুদ্র। কিন্তু ভৌগলিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শুকিয়ে যায় সমুদ্রের সমস্ত জল। আর কালক্রমে সমুদ্রের তলদেশ থেকে বেরিয়ে আসে ওই সব চুনাপাথরের পাহাড়। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, খোলা হাওয়ায় দীর্ঘকাল পড়ে থাকার কারণে ওই সব পাথরের ভিতরে থাকা খনিজ পদার্থগুলির রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যেও বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে । আর সেই কারণেই অমন গাছের মতো অদ্ভুত আকার ধারণ করেছে পাথরগুলি।
আরও শুনুন: চাকা নড়েও না, চড়েও না! তবু এই রেলগাড়িতে ভিড় জমান অসংখ্য জঙ্গল-যাত্রী
এ তো গেল বৈজ্ঞানিকদের কথা। স্থানীয়রা কিন্তু মনে করেন, এই পাথুরে জঙ্গলের নেপথ্যে রয়েছে অন্য গল্প। শোনা যায়, স্থানীয় উই আদিবাসী সম্প্রদায়ের মেয়ে আশিমা বিয়ে করতে চেয়েছিলেন নিজের পছন্দের এক যুবককে। কিন্তু তাদের ভালবাসার রাস্তায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তথাকথিত সমাজ। আর সেই শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিল আদিবাসী মেয়ে আশিমা। সেখান থেকেই তৈরি হয় ওই পাথুরে জঙ্গল। সমস্ত পাথর-গাছের ভিড়ে একটি পাথর নাকি অবিকল আশিমার মতোই দেখতে। মাথায় টুপি, হাতে ঝুড়ি। গোটা শিলিন জঙ্গলে সবচেয়ে জনপ্রিয় জায়গা ওই আশিমা পাথরই। প্রতি বছর জুন মাসে শিলিনে এসে নানা উৎসবে মেতে ওঠে উই সম্প্রদায়ের মানুষ। নানা রকম ইভেন্টের আয়োজন করা হয়।
অনেকগুলি ছোট ছোট পাথুরের জঙ্গলে ঘেরা এই শিলিন। তার মাঝখানে রয়েছে গুহা, জলপ্রপাত থেকে শুরু করে গোটা একটি হ্রদও। বয়ে গিয়েছে দুটি ভূগর্ভস্থ নদীও। সব মিলিয়ে পর্যটকদের কাছে এই জায়গার আকর্ষণ নেহাত কম নয়। ইউনেস্কোর স্বীকৃতির পর থেকে পর্যটকেদের ভিড় আরও বেড়েছে। হবেই বা না কেন? গাছপালা বা পশুপাখির জঙ্গল তো অনেকেরই দেখা। কিন্তু পাথরের জঙ্গল দেখার সৌভাগ্য ক-জনের হয় বলুন তো!