পুরনো দিনের মহিলারা অনেকসময় একটি প্রবাদ আওড়াতেন, ঘরজ্বালানি পরভোলানি। অর্থাৎ কিনা, যার জ্বালাতনের চোটে ঘরের লোকজন অতিষ্ঠ, সেই কিনা বাইরের লোকজনের কাছে গেলে একেবারে অন্য অবতার। শিশুদের সম্পর্কে এমন কথা অনেকেই বলে থাকেন, তাই না? কিন্তু এই আচরণের নেপথ্যে কি কোনও কারণ রয়েছে? সে দিকটিই এবার খতিয়ে দেখলেন মনোবিদেরা। শুনে নেওয়া যাক।
অনেকসময়ই, অনেক মায়েরাই বলেন, জ্ঞান হওয়া থেকেই তাঁর সন্তান ভীষণ দুষ্টু। কিন্তু কোনও একদিন হয়তো প্রয়োজনের তাগিদে অন্য কারও কাছে বাচ্চাকে রেখে গিয়েছেন, ফিরে এসে শুনলেন উলটো কথা। জানতে পারলেন, শিশুর নামে মা-ই নাকি মিছিমিছি বদনাম করেছেন, সে তো দিব্যি শান্ত হয়েই ছিল। শুনে আপনার মনে হবে, এটা কীভাবে সম্ভব? এ যে অবিশ্বাস্য! বিশ্বাস করুন এটা শুধু আপনার নয়, পৃথিবীর বেশিরভাগ মায়েরই প্রশ্ন। রোজ রাতে বাচ্চাকে খাওয়াতে বসে হয়তো ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায় আপনার, ঘুম পাড়াতে গিয়ে ক্লান্তিতে আপনার চোখ ঢুলে এলেও সে দিব্যি সজাগ, পড়াতে বসালেও আপনাকে হিমশিম খেতে হয়, সব মিলিয়ে আপনি বুঝেই উঠতে পারেন না যে আপনার কাছেই সে এত দুষ্টুমি করে কেন। কিন্তু মনোবিদরা জানাচ্ছেন, এটাই স্বাভাবিক। অন্তত ৯৯.৯ শতাংশ বাচ্চার ক্ষেত্রে এমন আচরণকেই স্বাভাবিকের তকমা দিচ্ছেন তাঁরা। কিন্তু কেন? তাঁরা বলছেন, ছোট বাচ্চারা আসলে তাদের মায়ের দেহের ফেরোমনের গন্ধ অনুভব করতে পারে। এই গন্ধ তাদের ভরসা জোগায়, নিরাপত্তার অনুভূতি দেয়। তারা বুঝতে পারে যে, এই জায়গাটিতে তারা সবচেয়ে বেশি নিরাপদ।
আরও শুনুন: লাগে না বেতন, প্লাস্টিক জমা দিয়েই স্কুলে পড়াশোনা পড়ুয়াদের
প্রশ্ন উঠতে পারে যে, এই নিরাপত্তার বোধ এলে তো শিশুর শান্ত হওয়ারই কথা। সেখানে সারাদিন পর মা-কে দেখলেই সে বায়না, আবদার, দুষ্টুমি, সবকিছু নিয়ে হাজির হবে কেন? মনোবিদরা জানাচ্ছেন, তারও কারণ ওই নিরাপত্তার অনুভূতিই। বাচ্চারা ছোট থেকেই, অজান্তেই তাদের ভালো-মন্দ অনুভূতিগুলিকে সামলাতে শেখে। কোন অনুভূতিকে কখন প্রকাশ করতে হবে আর কখন কোন অনুভূতি চেপে রাখতে হবে, তা বুঝতে চেষ্টা করে। আর সারা দিন পর মায়ের চেনা গন্ধ, নিশ্চিন্তির আশ্রয়ে, সারা দিনের চেপে-ঢেকে রাখা সেই ভাল-মন্দ অনুভূতিগুলো বেরিয়ে পড়ে। যেগুলোর সঠিক কারণ বা প্রকাশ সে তখনও জানে না, শেখেনি। কিন্তু সে এটুকু মনে মনে জানে যে, এখানে তার আর কোনও মুখোশের বা আড়ালের দরকার পড়বে না। তাই সে তখন মায়ের সমস্ত সময়, সমস্ত মনোযোগ দাবি করে বসে।
আরও শুনুন: বিদেশে গিয়েও লাগে না বাড়িভাড়া, প্রায় বিনামূল্যেই থাকার সুযোগ মেলে কোথায়?
সত্যিই তো মায়ের চেয়ে বেশি নিশ্চিন্তির আশ্রয়, এ পৃথিবীতে আর কোথায় আছে। সারাদিনের সমস্ত মন খারাপের কথা, খারাপ কিংবা ভালো লাগার কথা সে আর কার কাছে বলবে! উলটোদিকে মায়ের পক্ষেও হয়তো সবসময় এই অবস্থা সামলানো সম্ভব হয় না, বিশেষ করে কাজ থেকে বাড়ি ফিরে। কিন্তু বাচ্চাদের মেজাজ সামলানোর জন্য মায়েদের সবার আগে নিজের মেজাজের রাশ টানতে হবে, এমনটাই পরামর্শ দিচ্ছেন মনোবিদরা। ২০১৮ সালের একটি সমীক্ষা বলছে, যেসব মায়েরা নিজেদের অনুভূতি ঠিকমতো প্রকাশ করতে সক্ষম, তাঁদের বাচ্চাদের অনুভূতি প্রকাশ অনেক নিয়ন্ত্রিত। বিক্ষিপ্ত পরিবেশ-পরিস্থিতিতে আপনার বিপর্যস্ত মানসিক অবস্থা, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আপনার সন্তানের মানসিক অবস্থার ওপর প্রভাব ফেলবে। তাই শিশু সন্তানের সামনে সেই বিপর্যস্ত অবস্থা যাতে বেলাগাম ভাবে প্রকাশ না পায়, তা ঠিক করতে হবে আপনাকেই। নিজেকে বোঝান, যেভাবে আপনার ছোট্ট বাচ্চাটিকে রাগ সামলাতে বলেন আপনি। খারাপ পরিস্থিতি এড়াতে সেই মুহূর্তে ঘটনাস্থল থেকে সরে যাওয়াও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে অনেকখানিই সহায়তা করে। শিশুদের অস্থিরতা, অতিরিক্ত দুষ্টুমি সামলানোর জন্য অভিভাবকদের আরও বেশি করে ধৈর্য ধরারই পরামর্শ দিচ্ছেন মনোবিদেরা।