রাজনীতি মানে ক্ষমতার লড়াই। আর সেই লড়াইয়ে জেতার জন্যই চলতে থাকে দলবদলের অভ্যাসও। কখনও না কখনও সেই প্রবণতার সাক্ষী হয়েছে সব দলই। সম্প্রতি অজিত পওয়ার যেমন এনসিপি ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন, তেমনই কংগ্রেস ছেড়ে এনসিপি গড়েছিলেন তাঁর কাকা শরদ পওয়ারও। বস্তুত, পওয়ার থেকে মমতা, কংগ্রেসের দীর্ঘ যাত্রায় বিদ্রোহের ইতিহাসও দীর্ঘ। আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
রাজনীতিতে নীতির জোর ঠিক কতখানি, তা নিয়ে প্রশ্ন চলতেই পারে। গদি দখলের জন্য এক দল ছেড়ে বিরোধী দলে যোগ দেওয়া সেখানে নতুন কিছু নয়। সম্প্রতি অজিত পওয়ারের দলবদলের ঘটনায় আরও একবার উসকে উঠেছে সেই প্রসঙ্গ। বিশেষ করে চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনের আগে কংগ্রেসের পাশে দাঁড়িয়ে যে বিরোধী জোটের ডাক দিয়েছে একাধিক বিজেপিবিরোধী দল, অজিতের এনসিপি ত্যাগ সেখানে বড় ধাক্কা। কিন্তু অজিত পওয়ার যা করলেন, সেই দলত্যাগের ঘটনা এর আগে ঘটিয়েছিলেন তাঁর কাকাও, অর্থাৎ এনসিপি সুপ্রিমো শরদ পওয়ার। বিজেপিকে হারাতে এখন যে কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তিনি বিরোধী জোট গড়তে চাইছেন, একসময় সেই কংগ্রেসের হাত ছেড়েছিলেন তিনি নিজেই। তবে শরদ পওয়ার একা নন। ভারতের প্রথম রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের রাজনীতিতে পথ চলা যতটা দীর্ঘ সময় ধরে, সেই দীর্ঘ সময়ে একাধিকবার এমন বিদ্রোহ ঘটেছে। দল বদলে ফেলেছেন বা নয়া দল গড়েছেন একাধিক বিদ্রোহী নেতা। কারা তাঁরা?
আরও শুনুন: সংখ্যালঘুরা বেশি সুবিধা পেয়েছেন মোদির আমলেই! কোন তথ্যে এমন দাবি বিজেপি নেতার?
প্রথমে শরদ পওয়ারের কথাই ধরা যাক। কংগ্রেস ছেড়ে ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি বা এনসিপি নামে নতুন দল গড়েছিলেন তিনি। আসলে ১৯৯৯-তে সোনিয়া গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন, এমন জল্পনা তৈরি হয়। আর সে কথা একেবারেই মেনে নিতে পারেননি কংগ্রেসের এই বড় নেতা। তাঁর সাফ কথা ছিল, হয় তিনি, নইলে মনমোহন সিং-ই প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার। সুতরাং হাত শিবির ছেড়ে দেওয়ারই সিদ্ধান্ত নেন পওয়ার। যদিও পরে ইউপিএ সরকারের শাসনকালে বড় ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। কংগ্রেস ও শিব সেনার সঙ্গে জোট বেঁধেই মহারাষ্ট্রে বিজেপি সরকার ফেলে মহাবিকাশ আগাড়ি সরকারও গড়েছেন। কিন্তু তিনি কংগ্রেসের সদস্য হয়েই থাকলে রাহুল-সোনিয়ার কংগ্রেস বাড়তি সুবিধা পেত বলেই মনে করে রাজনৈতিক মহলের একাংশ।
এই সময়ের রাজনীতিতে বিজেপিবিরোধী জোটের অন্যতম মুখ যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এমনকি জোট ছাড়াই বিজেপির বিরুদ্ধে একাই লড়বে তাঁর দল, এ কথা বলার সাহসও দেখিয়েছেন তিনি। কথায় কথায় কংগ্রেসকে বিঁধতেও ছাড়েন না তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো। আর এই দ্বন্দ্বের শুরুটা আসলে হয়ে গিয়েছিল নয়ের দশকেই। রাজীব গান্ধী হত্যার পর কংগ্রেসের জাতীয় রাজনীতিতে খানিক কোণঠাসাই হয়ে পড়েছিলেন রাজীব-অনুগামী মমতা। ১৯৯২-এ তিনি দলের আঞ্চলিক সভাপতি হওয়ার সুযোগ পাননি। ১৯৯৭-এর আগেও যখন কংগ্রেস মমতাপন্থীদের সরিয়েই রাখছিল, তখন সরাসরি দল ছেড়ে বেরিয়ে যান মমতা। ইন্দিরা বা রাজীব কেউই যে কংগ্রেসে নেই, সেই দলে থাকার যুক্তি নেই- এমনটাই ছিল মমতার বক্তব্য। তারপর থেকে তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে কংগ্রেসের সম্পর্ক অম্লমধুর হয়েই থেকেছে।
সোনিয়ার জন্যই কংগ্রেস ছাড়ছেন, এমন দাবি করেছিলেন জগনমোহন রেড্ডি। ২০০৯ সালে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় তৎকালীন অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ওয়াইএস রাজাশেখর রেড্ডির মৃত্যুর পরেই তাঁদের দ্বৈরথের সূত্রপাত। মুখ্যমন্ত্রীর মৃত্যুর কথা শুনে অনেকে আত্মহত্যা করেছেন, তাই তাঁদের স্মরণে এক বিশেষ যাত্রা করার অনুমতি চেয়েছিলেন জগনমোহন। দল অনুমতি না দিলেও তিনি পিছু হটেননি। এর উপরে আবার নতুন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবেও তাঁকে মনোনীত করেননি সোনিয়া। এরপরেই ওয়াইএসআর কংগ্রেস গড়ে নির্বাচনে লড়েন জগনমোহন রেড্ডি।
আরও শুনুন: রাজীব, মনমোহনের থেকে মোদির বিদেশসফর অনেকটাই আলাদা, কেন এমন দাবি বিদেশমন্ত্রীর?
কংগ্রেসের অন্দরে ‘কালেক্টর সাহেব’ নামে পরিচিত অজিত যোগীও ছিলেন এই বিদ্রোহীদের দলে। সোনিয়া গান্ধী রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পর অজিতের থেকে যথেষ্ট সাহায্য পেয়েছিলেন তিনিও। মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেসকে শক্ত জমিতে দাঁড় করানোর পিছনেও তাঁর ভূমিকা ছিল। তার পুরস্কার হিসেবেই নবগঠিত ছত্তিশগড়ের মুখ্যমন্ত্রী হন তিনি। যদিও ২০১৬-তে এই বন্ধুত্ব ভেঙে যায়। রাজ্যসভায় মনোনয়ন না মেলার কারণেই তাঁর এই সিদ্ধান্ত, এমনটাই মনে করে ওয়াকিবহাল মহল।
সাম্প্রতিক কালে রাজস্থান কংগ্রেসের অন্দরমহল উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল অশোক গেহলট এবং সচিন পাইলটের দ্বন্দ্বের জেরে। গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব থামাতে বিদ্রোহী পাইলটের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে, এমনকি রাহুল গান্ধী নিজেও। জল্পনা চলছিল পাইলটের দলবদল নিয়েও। অতীত হোক কি বর্তমান, কংগ্রেসের অন্দরের বিদ্রোহের ধারা যে এখনও চলছেই, সে কথাই ফের উসকে দিয়েছে এই ঘটনা।