গীতা ছিল মহাত্মা গান্ধীর প্রিয় গ্রন্থ। গীতার একাধিক শ্লোকের উপরেই যেন দাঁড়িয়ে ছিল তাঁর সমগ্র কর্মজীবন। আসুন, ফিরে দেখা যাক সেই শ্লোকগুলি।
রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠির জবাব দিতে গোটা একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন গান্ধী। আর সেখানেই তিনি উল্লেখ করেছিলেন গীতার একাধিক শ্লোক, যেগুলি তাঁর কাছে মহামন্ত্রের মতো পালনীয় ছিল। বস্তুত মহাত্মা গান্ধীর বহুধাবিস্তৃত কর্মকাণ্ড, পাশাপাশি তাঁর কথায় ও লেখায় যে ব্যক্তিগত নৈতিকতা জেগে থাকে, তার উৎস খুঁজতে গেলে গীতার কাছে পৌঁছতেই হবে। তাঁর সমগ্র আন্দোলনের চালিকাশক্তি ছিল অহিংসা, আর মহাভারতও শেষ পর্যন্ত হিংসার অসারতার কথাই বলে। সেই মহাভারতেই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে অর্জুনকে যে উপদেশগুলি দিয়েছিলেন কৃষ্ণ, গীতা আসলে যে উপদেশের সমাহার, তাকে শিরোধার্য করেছিলেন গান্ধীও। যদিও জীবনের প্রথমে অনেকগুলো বছর কেটে গিয়েছিল গীতা না পড়েই। ফলে তাঁর দুই বন্ধু যখন সংস্কৃত গীতা পড়তে গিয়ে তাঁর কাছে কিছু শব্দের মানে জিজ্ঞাসা করে বসলেন, তখন গান্ধী কিছুই বলতে পারেননি। নিজের আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, এই ঘটনায় অত্যন্ত লজ্জিত হয়েছিলেন তিনি, কারণ তখনও না সংস্কৃত না গুজরাতি, কোনও ভাষাতেই তিনি গীতা পড়ে দেখেননি। সেই লজ্জা থেকেই তাগিদ এসেছিল গীতা পড়ে দেখার, আর তা-ই গান্ধীর সামনে খুলে দিয়েছিল সম্পূর্ণ নতুন এক পথ।
আরও শুনুন: অভ্রান্ত নন, অবতারও নন… তবু গান্ধীকে অস্বীকারে ক্ষতি ভারতবর্ষেরই
গীতার যে শ্লোকগুলি গান্ধীর কাছে ছিল মহামন্ত্রের মতো, সেগুলি পাওয়া যায় তৃতীয় অধ্যায় অর্থাৎ কর্মযোগ-এ। মহাত্মাকে স্মরণের মুহূর্তে ফিরে দেখা সেই শ্লোকগুলি:
গীতার তৃতীয় অধ্যায়ের অষ্টম শ্লোক বলে,
“নিয়তং কুরু কর্ম ত্বং কর্ম জ্যায়ো হ্যকর্মণঃ।
শরীরযাত্রাপি চ তে ন প্রসিধ্যেদকর্মণঃ।।”
জগদীশচন্দ্র ঘোষ অনুবাদ করে এই শ্লোকের অর্থ বুঝিয়ে বলেছেন, তুমি নিয়ত কর্ম করো, কর্মশূন্যতা অপেক্ষা কর্ম শ্রেষ্ঠ। কিন্তু সেই কর্ম কী? সাধারণত নিয়ত কর্ম অর্থ হল কর্তব্যকর্ম বা স্বধর্ম পালন। কিন্তু একইসঙ্গে ‘গীতা’-কে উপজীব্য করে দেওয়া বক্তৃতামালায় গান্ধীজি বারবার জোর দিয়েছিলেন পরিণামের কথা ভুলে নিষ্কাম কর্ম করে চলার উপর।
যজ্ঞার্থাৎ কর্মণোহন্যত্র লোকোহয়ং কর্মবন্ধনঃ ।
তদর্থং কর্ম কৌন্তেয় মুক্তসঙ্গঃ সমাচর॥
এই শ্লোকেও বলা হচ্ছে যে, যজ্ঞের উদ্দেশ্যে করা কর্ম ছাড়া অন্য কর্ম বন্ধনের কারণ। এই যজ্ঞের মূল কথা পরহিতের কারণে আত্মত্যাগ করা।
সহযজ্ঞাঃ প্রজাঃ সৃষ্ট্বা পুরোবাচ প্রজাপতিঃ ।
অনেন প্রসবিষ্যধ্বমেষ বোহস্ত্বিষ্টকামধুক্ ॥
আরও শুনুন: মহাত্মা গান্ধীর পথেই আত্মনির্ভরতা শিখুক পড়ুয়ারা, চরকা কাটার ঘর বানাল মাইসুরুর স্কুল
প্রজাপতি যে যজ্ঞের কথা বলেছেন, অর্থাৎ পরস্পরের আদানপ্রদান ও ত্যাগের ভিত্তিতে কর্তব্যকর্ম নির্ধারণ করা, এখানেও সে কথাই বলা হচ্ছে।
আসলে মহাত্মা গান্ধীর সমগ্র যাপন, সমগ্র চর্চার উৎসমুখে আলোকশিখা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল গীতার এই শ্লোকগুলি। মহাত্মা গান্ধীকে বুঝতে হলে তাই গীতার কাছে ফিরে যাওয়াও জরুরি হয়েই থাকবে।