ধরেই নেওয়া হয় যে, কিছু শেখানোর জন্য বা ভুল শুধরানোর জন্য শাসন করা জরুরি। তবে ঠিক কতটা শাসন, শাসনের গোত্রেই পড়ে, আর কখন তা হেনস্তায় পর্যবসিত হয়- তা বোঝা সহজ নয়। সম্প্রতি এই প্রসঙ্গ সামনে এসেছে ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকের সূত্রে। হেনস্তার প্রতিবাদের সূত্রে সামনে এসেছে আরও অনেক কথাই। কিন্তু দুর্ব্যবহার যদি সাধারণ নিয়ম হয়ে যায়, হেনস্তা চিনে নেওয়া আরও কঠিন হবে না কি? প্রশ্ন তুললেন রণিতা চট্টোপাধ্যায়।
পড়া না পারলে হাতের আঙুলের ফাঁকে পেনসিলের চাপ। নাটকের রিহার্সালে ভুল হলে চড়-থাপ্পড়। এসবকে আর আলাদা করে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। ধরেই নেওয়া হয় যে, কিছু শেখানোর জন্য বা ভুল শুধরানোর জন্য শাসন করা জরুরি। তা হয়তো অস্বীকার করা যায় না। তবে ঠিক কতটা শাসন, শাসনের গোত্রেই পড়ে, আর কখন তা হেনস্তায় পর্যবসিত হয়- তা বোঝা সহজ নয়। তাই শাসনের নামে কেউ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যেতে পারেন। আর তা সামনে এলে বোঝা যায় আসলে তা হেনস্তাই। এই দুয়ের সীমারেখা এতটাই ধূসর যে, সচরাচর আমরা দুটোর পার্থক্য বুঝতেও প্রস্তুত থাকি না।
আরও শুনুন:
হোক না ‘কৃত্রিম পুরুষ’, রোবটের হাত তবু নারীর শরীরই ছুঁতে চায়!
সম্প্রতি এই প্রসঙ্গ সামনে এসেছে ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকের সূত্রে। যা নিয়ে বিগত কিছুদিন ধরে বাংলা সংস্কৃতির আপাত শান্ত জগতে ঝড় বইছে। আসলে এমনিতে ঝড় থাকে না তা তো নয়, তবে সাধারণত তা লুকিয়ে থাকাটাই দস্তুর। যে হেনস্তার কথা নিয়ে ঝড় ওঠার কথা ছিল, সেই হেনস্তার কথা বলতে গেলেই যদি মিউট হয়ে যায় মাইক্রোফোন, কিংবা মুছে যায় লেখা, তাহলে ঝড় আর উঠবে কী করে! প্রতিবাদ করতে চাইলে পালটা কণ্ঠরোধই যে নিয়ম, এ কথা তো ইতিহাসই শিখিয়ে দিয়েছে বরাবরই। আর ইতিহাস মেনেই, সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে। তবুও, এবার ঝড়টা এসেই পড়ল। প্রথমে অবশ্য আলতো সুরে কেউ কেউ বলেছিলেন, ‘ঝড়কে গিয়ে জানিয়ে এসো, কী মানে হয় এমন করার?’ কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ যেদিকে গড়াল, তাতে এবার ভেসে গেল আলতো কথারা। যে ব্যবহার খারাপ, যে ব্যবহার হেনস্তার পর্যায়ে পড়ে, তাকে আর কেবল ভীষণ বকব আড়ালে বলেও চেপে রাখা গেল না। হেনস্তার প্রতিবাদে সরব হয়ে উঠল অনেকগুলো স্বর। আর এত স্বর শোনা গেল বলেই, তার মধ্যে থেকে উসকে উঠল আরও অনেকরকম কথা। যেসব ঘটনা বা আচরণ এত বড় ইস্যু হয়ে ওঠে না বলেই, তা নিয়ে সচরাচর কথা হয় না, সেইসব কথারাও এবার সামনে এসে পড়ল। আর তা থেকেই জেগে উঠল একটা অমোঘ প্রশ্ন, দুর্ব্যবহার যদি সাধারণ নিয়ম হয়ে যায়, হেনস্তা চিনব কী করে?
যদি শুধু থিয়েটারের জগতের কথাই ধরি, দেখা যাচ্ছে সেখানে দুর্ব্যবহারের নানাবিধ রকমফের। কাজ শেখানোর পদ্ধতি হিসেবেই দীর্ঘদিন ধরে চালু রয়েছে সেসব আচরণ। কেমন আচরণ? কখনও কুকথা বলা, কখনও ব্যক্তিগত পরিসরে ঢুকে ব্যঙ্গবিদ্রুপ, কখনও কখনও গায়ে হাত তোলাও। যেমন সম্প্রতিই, এক নাট্যকর্মী অভিযোগ তুলেছেন, দলের হিসেবনিকেশ নিয়ে প্রশ্ন তোলায় অভিনয়ের ছুতোয় চড় খেতে হয়েছিল তাঁকে। আবার যৌন হেনস্তার ঘটনা নিয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে এক অভিনেত্রী-পরিচালক স্বীকার করে নিয়েছেন, শেখানোর সময় চড় মারতেন তিনিও। কারণ তেমনটাই হয়, তেমনটাই করা নিয়ম বলে শিখে এসেছেন তিনি। উৎপল দত্ত এমনটাই করতেন, এই ধুয়ো তুলে থিয়েটারে সহকর্মীদের আকথা-কুকথা বলার চল তো রয়েছেই। না, এই প্রেক্ষিতে কেবল থিয়েটারকেই একা কাঠগড়ায় দাঁড় করানো চলে না। ক্লাসরুমে বা টিউটোরিয়ালে অনেকসময়ই পড়ুয়ার প্রতি একই আচরণ করেন বহু শিক্ষক। শাস্তির নিত্যনতুন উপায়ও উদ্ভাবন করেন তাঁরা। অবশ্য তা নিয়ে সামাজিক পরিসরেও একটা বাঁধা বুলি রয়েছে, না মারলে নাকি শিক্ষালাভ সম্পূর্ণ হয় না। এমনকি কর্মক্ষেত্রের পরিসরেও কান পাতলে শোনা যাবে এহেন মতবাদ। অনেকেই বিশ্বাস করেন, গালিগালাজ না করলে অধস্তনদের কাজ শেখানো যায় না মোটেই। অথচ, যোগ্যতার নিরিখে যে যেখানেই থাকুন, বয়সের যতই তারতম্য থাকুক, মানুষ হিসেবেই তো একজন মানুষের স্বাভাবিক সম্মান প্রাপ্য। সেই হিসেবে যে কারও সঙ্গেই যা-ইচ্ছে তাই আচরণ করা চলে না, এ কথাও বলাই বাহুল্য। সেই নিক্তিতে দেখতে গেলে এই প্রতিটি আচরণই সমস্যাজনক। কিন্তু তা নিয়ে প্রশ্ন তো ওঠেই না, বরং ‘এ আর এমন কী’ বা ‘এমনটা তো হয়েই থাকে’-র মোড়কে তাকে ক্রমাগত মান্যতা দিয়ে চলা হয়। আসলে সমাজের সর্বত্রই যে গুরুবাদ চারিয়ে রয়েছে, তার দরুনই বয়সে বা পদের নিরিখে বড় মানুষদের যাবতীয় কাজ মেনে নেওয়ার এক অভ্যাস রয়েছে আমাদের। সম্মান করা আর প্রশ্ন করার মধ্যে আদতে যে কোনও বিরোধ নেই, এই বক্তব্যটিকে তাই প্রায়শই গুলিয়ে দেওয়া হয়। বরং প্রশ্ন করলেই সে প্রশ্ন মুছে দিতে তৎপর হয়ে পড়ে ওই সামাজিক মান্যতাই।
আরও শুনুন:
World Theatre Day: ‘নাটক’ যেন নয়া অপশব্দ! প্রতিবাদ রোখারই চাল নয় তো?
এবার কথা হল, এ জাতীয় আচরণ আর যৌন হেনস্তা বা শারীরিক হেনস্তা একই সারিতে বসবে কি? না, দুয়ের মাত্রায় তর-তম রয়েছে। কিন্তু গোত্রের বিচারে? দুই আচরণই তো আদতে উলটোদিকে থাকা আরেকজন মানুষের প্রতি দুর্ব্যবহার, তাই নয় কি? আর একজন সহনাগরিকের প্রতি ঠিক কেমন ব্যবহার করা যায় না, সে বিষয়টি নিয়েই কি আমরা আদৌ সচেতন? এমনিতে আমাদের আশেপাশে সর্বত্রই অসহিষ্ণু আচরণ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে ক্রমশ। যার হাতে যেটুকু ক্ষমতা রয়েছে, সেটুকু কাজে লাগিয়েই সুযোগমতো অন্য কোনও মানুষের দিকে দুর্ব্যবহার ছুড়ে দেওয়া দস্তুর হয়ে উঠেছে। সেই দুর্ব্যবহার যখন মাত্রা বাড়িয়ে হেনস্তায় পর্যবসিত হচ্ছে, একমাত্র তখনই তা প্রতিবাদের নিশানায় এসে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু সেই আচরণের ভূমি তো আসলে তৈরি হয়ে চলেছিল দীর্ঘদিন ধরেই, তাই নয় কি? ভেবে দেখলে, এই পুরো বিষয়টাতেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে এক ও একমাত্র ক্ষমতার স্বর। সে ক্লাসরুমে হোক, মহলার ঘরে হোক কি অফিস-কাছারিতে। পাওয়ার পজিশনে যে নিচে অবস্থান করছে, তার প্রতি চাইলেই দুর্ব্যবহার করে ফেলা যায়- ক্ষমতার ঔদ্ধত্যে এমনটাই হয়ে উঠেছে সাধারণ নিয়ম। আর ক্রমে ক্রমে আমাদের সম্মিলিত চেতনাও সেই সাধারণ নিয়মকেই আত্মস্থ করে ফেলেছে। কিন্তু দুর্ব্যবহার যদি সামাজিকভাবে মান্যতা পেয়েই যায়, তাহলে হেনস্তাকে চেনার পথ আর কতটুকুই বা খোলা থাকবে!