কোনও সমকামী যুগল কি বিয়ের অধিকার পাবেন? একটি সন্তানকে নিজের করে নেওয়ার অধিকারও কি পাবেন তাঁরা? এ নিয়ে শেষমেশ রায় শোনাল দেশের শীর্ষ আদালত। কিন্তু হাজার হাজার বছর আগেই এই ইস্যুতে কথা বলেছিল ভারতীয় পুরাণও। সেখানে কি মান্যতা পেয়েছিল সমকাম? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর অপেক্ষা ছিল রায় ঘোষণার। শেষ পর্যন্ত সেই রায়ে সমলিঙ্গ বিবাহকে স্বীকৃতি দিল না সুপ্রিম কোর্ট। কোনও সমলিঙ্গ যুগল সন্তানকে দত্তক নিতে পারবেন কি না, সে বিষয়েও প্রধান বিচারপতি সহ পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ একমত হতে পারেনি। তবে সমকাম যে কোনও অপরাধ নয়, এমনকি স্রেফ শহুরে অভ্যাসও নয়, সে কথা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। তাই সামাজিকভাবে সমকামকে মান্যতা দেওয়ার পক্ষেই কার্যত সওয়াল করেছেন তিনি। কিন্তু কথা হল, সুপ্রিম কোর্টকে এ যুগে দাঁড়িয়েও যে কথা মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে, ভারতীয় সমাজে সে কথা আদৌ নতুন নয়। ভারতীয় পুরাণ ঘাঁটলে দেখা যাবে, এই নিয়ে কয়েক হাজার বছর আগেই কথা বলা হয়েছে সেখানে। বলা ভালো, এই বিষয়ক বক্তব্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বেদে, পুরাণে, মহাকাব্যে ও প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রে। শাস্ত্রে যেমন তৃতীয় প্রকৃতি বা তৃতীয় লিঙ্গের উল্লেখ রয়েছে, তেমনই স্মৃতিতে বা সংহিতায় ‘মহিলা চরিত্রের পুরুষ’ বা ‘পুরুষ চরিত্রের মহিলা’রও উল্লেখ মেলে। কামসূত্রে ক্লীবলিঙ্গকে মান্যতা দেওয়ার পাশাপাশি বলা হয়েছে, ক্লীবলিঙ্গেরও দ্বৈত সত্তা থাকে।
আরও শুনুন: বিয়ে ভাঙলেও নেই রেহাই! অন্য পুরুষের কাছে চড়া দামে বিক্রি স্ত্রী, অদ্ভুত প্রথা রাজস্থানে
আবার সন্তানের কথাই যদি ওঠে, তাহলে দেখা যায়, বেদে মিত্র আর বরুণের অন্তরঙ্গতার কাহিনি রয়েছে। এঁদের দুজনের অযোনিসম্ভূত সন্তানের কথাও জানা যায়। উর্বশীকে দেখে মিত্র এবং বরুণের বীর্যস্খলিত হলে এবং তা জলে পড়লে তা থেকে যথাক্রমে অগস্ত্য আর বশিষ্ঠের জন্ম হয়েছে, এমন উল্লেখ রয়েছে। অগ্নি আবার একদিকে স্বাহার স্বামী, অন্যদিকে সোম বা চাঁদের সঙ্গে তাঁর রমণের প্রসঙ্গও এসেছে। মৎস্যপুরাণ বলছে, বিষ্ণু একবার ‘মোহিনী’ নামে সুন্দরী রমণীর রূপ ধারণ করেন। তাঁকে দেখে মোহিত হয়ে তাঁর সঙ্গে মিলিত হন শিব, আর উভয়ের এই মিলনে জন্ম হয় আয়াপ্পার। যে আয়াপ্পা পূজিত হন শবরীমালা মন্দিরে।
যে রামায়ণ নিয়ে সম্প্রতি এত কথা, সেই রামায়ণ কী বলছে এই প্রসঙ্গে? কৃত্তিবাসী রামায়ণ মতে, সূর্যবংশের রাজা দিলীপের মৃত্যু হলে তাঁর দুই বিধবা রানিকে পরস্পরের সঙ্গে উপগত হওয়ার নির্দেশ দেন শিব। যে মিলনে হাড়হীন এক শিশুর জন্ম হয়। পরে অষ্টাবক্র মুনির বরে সেই শিশুটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পান, নাম হয় ভগীরথ। তেরো শতকের কাশ্মীরী পুথি জয়দ্রথের ‘হরচরিতাচিন্তামণি’ আবার গণেশের জন্ম নিয়েও অন্য কথা বলে। এই পুথি অনুযায়ী পার্বতীর রজঃধোয়া জল খেয়ে ফেলার দরুন তাঁর হস্তীমুখ সখী মালিনীর গর্ভে হাতিমাথা গণেশের জন্ম হয়।
আরও শুনুন: ‘সাত পাক ছাড়া বৈধ নয় হিন্দু বিয়ে’, মন্তব্য আদালতের, কেন এই রীতি পালিত হয় জানেন?
এ ছাড়া প্রাচীন ভারতের শিল্পকলা ও স্থাপত্যেও সমপ্রেমের কম সাক্ষ্য মেলে না। কোনারক থেকে খাজুরাহো, একাধিক মন্দিরগাত্রে তার নিদর্শন রয়েছে। আজকের দিনে সমকাম নিয়ে সমাজ অস্বস্তিতে পড়লেও, প্রাচীন ভারত যে এ বিষয়ে মুক্ত ভাবনার পরিচয়ই দিয়েছিল, তা কিন্তু বলাই যায়।