ধর্ষিতা নয়, ধর্ষকের জন্য লজ্জা পাওয়া বরাদ্দ হোক। এই লক্ষ্যেই শুরু হয়েছিল ‘শেম দ্য রেপিস্ট’ বা ‘ধর্ষককে লজ্জা দাও’ আন্দোলনের। কীভাবে শুরু হয়েছিল এই আন্দোলন? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
নারীর সম্মান তার যোনিতে রাখল কে! প্রশ্ন তুলেছিলেন লিঙ্গসাম্য আন্দোলনের লড়াকু কর্মী কমলা ভাসিন। সত্যিই তো, কোনও নারীকে হেনস্তা করা হলে, ধর্ষণ করা হলে বলা হয় তাঁর সম্মানহানি হয়েছে। ধর্ষিতাকে নিয়েই আড়ালে আবডালে চলে কানাকানি, ফিসফাস। তাঁকেই সবাই এড়িয়ে চলে। অথচ এই গোটা ঘটনায় তাঁর তো কোনও হাত ছিল না। যাঁকে বলপূর্বক হেনস্তা করা হয়েছে, তাঁকেই কেন লজ্জা পেতে হবে! আসলে তো ধর্ষিতা নয়, লজ্জা পাওয়ার কথা ধর্ষকেরই। সেই কথা মাথায় রেখেই শুরু হয়েছিল ‘শেম দ্য রেপিস্ট’ বা ‘ধর্ষককে লজ্জা দাও’ আন্দোলনের। ধর্ষিতা, পাচার হয়ে যাওয়া মেয়েদের জন্যে কাজ করতে করতে এই আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিলেন সুনীতা কৃষ্ণন।
আরও শুনুন:
কাঁদছেন মা দুর্গা, তবু বধ তিন অসুরকে… খুদে শিল্পীর ভাবনা ভাবাচ্ছে সময়কে
একেকটি ধর্ষণ কাণ্ড সমাজ জুড়ে আলোড়ন ফেলে। ধর্ষকের শাস্তির দাবি ওঠে। আরেকদিকে দেখা যায়, পর্ন সাইটে তুঙ্গে উঠছে ওই ধর্ষণের ভিডিওর চাহিদা। হ্যাঁ, ধর্ষণ ভিডিওর রমরমা বাজার চলে পর্ন সাইটে। একে বলা হয় ‘রেপ ইন্ডাস্ট্রি’। ধর্ষণ করে সেই ভিডিও ক্যামেরায় তুলে রেখে অশ্লীল ছবির বিশ্ববাজারে চড়া দামে বিক্রি করে অপরাধীরা। পর্ন সাইটেও ছড়িয়ে যায় সেসব ভিডিও। কারও মুখ দেখা গেলেও পুলিশ ততক্ষণ নড়েচড়ে বসবে না, যতক্ষণ না কেউ অভিযোগ জানাচ্ছেন। আবার সে অভিযোগও নাম গোপন করে জানানোর উপায় নেই। এই পরিস্থিতিতেই ‘শেম দ্য রেপিস্ট’ আন্দোলনের কথা ভেবেছিলেন সুনীতা।
হায়দরাবাদের মেয়ে সুনীতাকেও পনেরো বছর বয়সে আটজন মিলে ধর্ষণ করেছিল। বহু লড়াইয়ের পর জীবনে ফিরেছেন তিনি। ধর্ষিতা মেয়েদের জীবনে ফেরাবার জন্যই তাঁর লড়াই চলছে জীবনভর। তিনি জানান, তাঁর এক বন্ধু হোয়াটসঅ্যাপ-এ এমনই দুটো ধর্ষণের ভিডিও পেয়েছিলেন। সে ভিডিওতে ধর্ষিতার পাশাপাশি ধর্ষক এবং তার সহযোগীদের মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। খোশমেজাজে তারা কেউ ধর্ষণ করছে, কেউ তার ভিডিও করছে, আর সেই ভিডিও এমএমএস হয়ে পৌঁছে যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে। সুনীতা বলেছিলেন, একাধিক পুরুষ যেভাবে কোনও লজ্জা-দ্বিধা-ভয় ছাড়া এ কাজ করছে, তা দেখে কার্যত স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তারপর তাঁর মনে হয়, এ নিয়ে কিছু না করলে তিনি আর নিজের চোখের দিকেই তাকাতে পারবেন না। সারারাত ধরে দুটো ভিডিও কাটছাঁট করে দেড় মিনিটের দুটো ক্লিপ তৈরি করেন সুনীতা। সেখানে ধর্ষিতাদের মুখ ঝাপসা করে দেওয়া হয়, আর ধর্ষকদের মুখ স্পষ্ট থাকে। ইউটিউবে দুটো ভিডিও আপলোড করে সুনীতা অনুরোধ জানান, ভিডিওতে যে ধর্ষকদের দেখা যাচ্ছে তাদের কেউ চিনতে পারলে যেন তাঁকে জানানো হয়। আর এইখান থেকেই শুরু হয় তাঁর ‘শেম দ্য রেপিস্ট’ আন্দোলন।
একজন ধর্ষকের পরিচয় জানিয়ে সুনীতার কাছে এগারোটি মেল আসে। কিন্তু স্থানীয় পুলিশের সাইবার সেল থেকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র সচিবের কাছে ছোটাছুটি করেও লাভ হয়নি। শেষে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন সুনীতা। শীর্ষ আদালত ধর্ষকদের ধরার জন্য সিবিআইকে নির্দেশ দেয়। অবশেষে গ্রেপ্তার হয় ওড়িশার এক জমি-বাড়ির ব্যবসায়ী ও তার এক সহযোগী। জানা যায়, পাঁচ বছর আগে একটি মেয়েকে ধর্ষণ করার সময় ওই ভিডিও তুলেছিল তারা। এই পাঁচ বছর অসংখ্য মানুষের কাছে ওই ভিডিও পৌঁছেছে। তা সত্ত্বেও ওই ধর্ষকেরা খুল্লমখুল্লা ঘুরে বেড়িয়েছে।
আরও শুনুন:
ধর্ষণে অভিযুক্তরা যদি ভোটে দাঁড়ান, বিচারের দাবি যাবে কোথায়?
‘শেম দ্য রেপিস্ট’ আন্দোলনের সূত্রে একের পর এক এহেন ভিডিও হাতে এসেছে সুনীতার। সে সবই তিনি আদালতে জমা দিয়েছেন, সবগুলির তদন্তভারই বর্তেছে সিবিআই-এর হাতে। সিবিআই ঘোষণা করেছিল, প্রতি ধর্ষককে চিহ্নিত করে ধরিয়ে দেওয়ার পুরস্কার এক লাখ টাকা। কিন্তু এমনটা চলতে চলতে আরও প্রায় ৯৫টি রেপ-ভিডিও এসে পৌঁছোয় সুনীতার হাতে। যা শুনে চমকে যায় খোদ শীর্ষ আদালত। কীভাবে এ সমস্যার মোকাবিলা করা যাবে, তার কোনও স্পষ্ট দিশা সুপ্রিম কোর্টও দেখাতে পারেনি। যারা ভিডিও করছে বা সে ভিডিও ছড়িয়ে দিচ্ছে, তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য লড়াই চালাচ্ছেন সুনীতারা। কিন্তু একদিকে ওই নৃশংস অত্যাচার তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করার জন্য ওঁত পেতে আছে একদল মানুষ, অন্যদিকে ওই ভিডিও নিয়ে আইনের দ্বারস্থ হওয়ার মতো মানুষের একান্ত অভাব। পাশাপাশি সাইবার সেলও কেন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে পদক্ষেপ করে না, প্রশ্ন তুলেছিল সুপ্রিম কোর্ট। সব মিলিয়ে ‘শেম দ্য রেপিস্ট’ আন্দোলন আরও একবার স্পষ্ট করে দিয়েছিল মেয়েদের সামগ্রিক বিপন্নতাকে।