কথা বলে, পিছু ডাকে সাড়া দিতে নেই। অমঙ্গল হয়। অথচ, সিমরন যখন পিছন ফিরে তাকান, গোটা হল হাততালিতে ফেটে পড়ে। আসলে, যে ফিরে দেখায়, ফিরে আসায় অপেক্ষা আর আনন্দ মিশে থাকে, সেখানে অমঙ্গল আসবে কোথা থেকে? ঠিক যেমন সুনীতা উইলিয়ামসের ফিরে আসায় আনন্দে ভাসছে গোটা বিশ্ব!
কেউ কেউ ফেরার হয়, কেউ কেউ ফেরে। সারা পৃথিবীতেই যেন এক ফেরার স্রোত। ‘ফেরা’ বড় সহজ কথা নয়। কে কোথা থেকে এসেছিল, কোথায় যাবে, কেউ কি জানে? ফিরে যাওয়ার জন্য কী কী লাগে? মনে রাখতে হয় গন্তব্য। সম্পর্কের টিপছাপ। টিকিট লাগে কখনও, কখনও কখনও ফেরা হয় স্মৃতির দূরপাল্লায়। যে দেশ ছেড়ে এসেছিল ’৪৭ সালে, সেই দেশ, অবিকল সেই দেশে কতজনই তো কখনও ফিরতে পারেনি আর। তবু তাদেরও তো ফেরা থাকে।
গন্তব্য জানলেই কি ফেরা যায়? পরিযায়ী শ্রমিকের ভিড়, কোভিডকালে ফিরতে পেরেছিল? ট্রেনের লাইনে কেন পড়েছিল তবে না-খাওয়া রুটি? সেই রুটি কখনও ফিরতে পারেনি আসন্ন খিদের মুখে। ‘নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণা’র এত পোস্টার খবরের কাগজে-রাস্তাঘাটে– ফিরে পাওয়া যায় তাঁদের?
:আরও শুনুন:
পিরিয়ডস থেকে ছুটি নেই মহাকাশেও! কী সমস্যায় পড়তে পারেন স্পেসে আটক সুনীতা উইলিয়ামস?
পৌনে বারোটার শেষ লোকাল। ভিড়হীন। ক্লান্তি আর ঘুমের বন্ধুত্ব গাঢ় হয়েছে। গল্প, হাসি, হইহল্লা– সবই কেমন ঝিমিয়ে পড়েছে। অযথা ধাক্কাধাক্কি নেই, হুড়োহুড়ি নেই। নির্দিষ্ট গন্তব্যে নামতে পারলেই হল। তারপর ফেরার পথে এগিয়ে যাওয়া। প্রতিদিনের অভ্যাস, তবু ফিরে আসায় যে কী আনন্দ সেটা গন্তব্য যত এগিয়ে আসে, তত গাঢ় হয়।
আলো, জাঁকজমক, নতুন জামা, ফুচকা, বেলুন, এগরোল– এসব ছাপিয়ে ধুনোর গন্ধ। ধোঁয়ায় ঢাকা চারদিক। ঢাক বাজছে। তালে তালে কাঁসর। দু’জনের বয়সের ফারাক অনেক, তবে ছন্দে ভুল হচ্ছে না এতটুকু। এভাবেই চার-পাঁচদিন কাটিয়ে দেওয়া। বিসর্জনের ক্লান্তি কাটিয়ে রাস্তায় নামা। একজনের খালি পা, অন্যজনের ছেঁড়া চটি। দু’জনেরই হাতে, কাঁধে, মাথায় ভারি ব্যাগ। ফেরার পথে যা আরও ভারি হচ্ছে। দয়া, ভিক্ষা, ভালোবাসায়। সবার পুজো শেষ, এঁদের আনন্দ শুরু। বাড়ি ফিরে জমিয়ে রাখা সব আনন্দ একদিনে উদযাপন করবে বাপ-বেটা-মা-মেয়ে।
:আরও শুনুন:
চর্চায় সিনেমার হিরো, বাস্তবের মহাকাশচারী রাকেশ শর্মা এখন কোথায়?
ঝড়ের খবর হঠাৎ এল। এদিকে, দিন-দুই আগেই ট্রলার রওনা দিয়েছে। যোগাযোগের উপায় নেই। যা হবে মেনে নিতে হবে। বিপদ ঘরে-বাইরে। বাঁধ ভাঙলে ঘর ভাসবে। ট্রলার না ফিরলেও ঘর ভাসবে। অপেক্ষা, অপেক্ষা আর অপেক্ষা। এমন সময় বৃষ্টি শুরু। জলের তোড়ে উথাল-পাথাল চারদিক। তবে ঝড়ের দাপট তেমন হল না। দিন-দুয়েকেই বৃষ্টি থামল। ট্রলারও ফিরল। মাছ ওঠেনি তেমন, তবে যারা গিয়েছিল, তারা ফিরেছে। বৃষ্টি শেষে স্বস্তি হয়ে তারা ফিরেছে।
প্রতি শীতে সাইবেরিয়া থেকে কতশত অতিথি উড়ে আসে। চারপাশ বদলে গেলেও পথ চিনতে তাদের ভুল হয় না। হয়তো প্রয়োজনে, তবু চাইলেই তা অন্য কোথাও মিটিয়ে নেওয়া যেত। প্রকৃতির নিয়মেই নিয়মের বদল হতে পারত। কিন্তু না, প্রতি বছর পরিযায়ী পাখিরা ফিরে ফিরে আসে। না-বলেও যেন বুঝিয়ে দেয়, ফিরে আসার মতো শান্তি আর কিছুতে নেই।
কিংবা মায়ের উপর রাগ করে বাড়ি ছেড়ে পালানো। সারাদিন এদিক ওদিক দৌড়ে-লাফিয়ে কাটিয়ে দেওয়া। বাগানের ফল, পাকা তেঁতুল, পেট ভরে যায় নিশ্চিন্তে। কিন্তু দিনের শেষে বাড়ি ফেরে দুর্গা। কপালে বিস্তর মার জুটবে, জেনেও। স্রেফ নিরাপদ আশ্রয়ের টানে? বোধহয় না। বাড়ি ফেরার আনন্দটা সেও বেশ টের পায়। যতই কষ্ট থাক, ওখানেই শান্তি।
:আরও শুনুন:
মহাকাশে গ্রহের প্যারেড! এক লাইনে পর পর ছয় গ্রহ, শেষ কবে হয়েছিল এমন?
নিজেকে ফিরে পাওয়াটাই আসল কথা। কেউ ক্রিকেট মাঠে, কেউ পরীক্ষার হলে, কেউ আবার ফেলে যাওয়া পাড়ার ক্যারাম বোর্ডে নিজেকে ফিরে পান। কতশত ফিরে আসার গল্প চারিদিকে ছড়িয়ে থাকে! তাতে প্রতিদিন জুড়ে যায় নতুন কিছু। ঠিক যেভাবে জুড়লেন সুনীতা। ৯ মাস মহাশূন্যে কাটিয়ে অবশেষে স্পেস স্টেশনকে বিদায় জানালেন দুই নভোচর– সুনীতা উইলিয়মস, বুচ উইলমোর। এলন মাস্কের পাঠানো স্পেস এক্স ড্রাগন ক্যাপসুল ক্রু নাইনে টানা ১৭ ঘণ্টার যাত্রাপথ। তারপরই পৃথিবীর মাটি ছোঁবেন দুই নভোচর।
মহাকাশপথকে কি দূরপাল্লা বলা যায়? কে জানে, তবে একে বলা যায় ‘ফেরা’– ফেরার মতো ফেরা।