স্বপ্ন ছিল ক্রিকেটার হওয়ার। কিন্তু ব্যাটের বদলে তুলি ধরতে হয়েছে। পেশা আর নেশাকে মিলিয়েছেন ক্যানভাসে। ছবিওয়ালা হয়েছেন ক্রিকেটের। অসংখ্য পোট্রেট আর হাসিমুখের ভিড়ে একাই ব্যাটিং করেন শুভজিৎ সাহা, হাসিমুখে রঙিন ছক্কা হাঁকান। তাঁর জীবনের গল্প শুনলেন শুভদীপ রায়।
সৈনিক হতে চেয়েছিলেন। হয়েছেন ক্রিকেটার। তবু যুদ্ধে নেমেছেন বহুবার। খেলার ময়দানে। দুর্ধর্ষ প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে জিতিয়েছেন ম্যাচ। দেশকে অনেকটা উঁচুতে পৌঁছে দিয়েছেন। মাঠের লড়াই ছেড়ে মাঠের বাইরের লড়াইয়ে নাম লিখিয়েছেন। সেখানেও ছক্কা!
অন্যজন ক্রিকেটার হতে চেয়েছিলেন। হয়েছেন শিল্পী। ব্যাট ছেড়ে তুলি ধরেছেন। রঙিন ছক্কা মেরেছেন। একের পর এক কটাক্ষের বাউন্সার সামলে টিকে থেকেছেন ক্রিজে। এঁকেছেন, গড়েছেন, নজর কেড়েছেন সবার। হাসি ফুটিয়েছেন অনেকের ঠোঁটে।
এঁরা দু’জন মুখোমুখি। সৈনিক হতে চাওয়া সেই ক্রিকেটারের ছবি এঁকেছেন শিল্পী। নিজেই তা পৌঁছে দিয়েছেন ক্রিকেটারের হাতে। শিল্পী ভালমতো জানেন ক্রিকেটারের সৈনিক হতে চাওয়ার কাহিনি। ক্রিকেটার অবশ্য শিল্পীর কথা জানেন না। ছবি দেখে চিনলেন, অবাক হলেন। দু’জনেই দু’জনকে উপহার দিলেন এমন কিছু, যা একে-অন্যের সঙ্গে থাকবে আজীবন।
যে-শিল্পীর কথা বলছি, তিনি শুভজিৎ সাহা। ক্রিকেটারের নামটা অবশ্য এতক্ষণে বোঝা হয়ে গিয়েছে– গৌতম গম্ভীর। শুধুমাত্র প্রাক্তন ব্যাটার কিংবা জাতীয় দলের কোচ নন, ভারতীয় ক্রিকেটের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রদের মধ্যে অন্যতম গৌতম গম্ভীর। তাঁর সঙ্গে দেখা করে কিছু উপহার দেওয়া কম কথা নয়। তবে শুভজিতের মতো শিল্পীর পক্ষে তা সম্ভব। কারণ নিজের জন্য তাঁকে আলাদা করে কিছু দাবি করতে হয় না, তাঁর আঁকা ছবিই সেই কাজ করে দেয়।
আইপিএলের মরশুমে ইডেনের বাইরেই দেখা মিলবে এই ছবিওয়ালার। নিজেকে ‘ক্রিকেটের ছবিওয়ালা’ বলতেই বেশি পছন্দ করেন। সেই নামেই সোশাল দুনিয়ায় নিজের পরিচিতি গড়েছেন। এমন নামের কারণ একটাই, ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা। ছোট থেকেই ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। পড়াশোনা তো বটেই, ছবি আঁকার ক্লাস পালিয়েও ক্রিকেট খেলেছেন বহুবার। তার জন্য বকুনিও জুটেছে। তবে ক্রিকেট থামেনি। শুরুতে পেশাগত ভাবে ক্রিকেটকে বেছে নেওয়ার সুযোগ হয়নি। তবে আঁকার পাশাপাশি খেলাও বজায় রাখার চেষ্টা চালিয়ে যান শুভজিৎ। নিজের চেষ্টা, অন্যান্য শিল্পীর কাজ দেখা, এভাবেই নিজেকে গড়েছেন। ধীরে ধীরে ছবি আঁকাই পেশা হয়ে ওঠে শুভজিতের। তবে স্রেফ আঁকা শিখিয়ে জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া, এমনটাও একেবারে পছন্দ ছিল না। তাই আঁকা আর খেলা পাশাপাশি বজায় রাখতে চান। এমন একটা সময়েই মাথায় বুদ্ধিটা আসে। খেলার মধ্যে বাঁচাটাকে আরও জীবন্ত করে তুলতে রং-তুলিতেই ধরতে শুরু করেন খেলার জগৎটাকে। সেই জগতের যারা ইন্দ্র-মিত্র-বরুণ, তাঁদের ছবি ফুটতে থাকে শুভজিতের ক্যানভাসে। রোহিত-কোহলি থেকে শুরু করে বরুণ চক্রবর্তী-রিঙ্কু সিং সবাইকে এঁকেছেন শুভজিৎ। তবে বেশিরভাগ আঁকাই খোলা রাস্তায় বসে, সবার সামনে। নিজের আঁকা ক্রিকেটারদের হাতে নিজেই তুলে দিয়েছেন। একবার নয়, বহুবার। আর সেই সুবাদেই গৌতম গম্ভীরের সংস্পর্শে আসা। সেদিনের কথা এখনও ভোলেননি শুভজিৎ। বিশেষ করে গম্ভীরের বলা কথাগুলো। হেরে যাওয়ার ভয় না পেয়ে নিজের কাজটা করে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন গৌতম গম্ভীর। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা ভাগ করেছিলেন তাঁর সঙ্গে। অল্প সময়ের সাক্ষাৎ। তবু বিশেষ হয়েই থেকে গিয়েছে শুভজিতের মনে। একইভাবে অন্যান্য খেলোয়াড়ও যখন তাঁর হাতে আঁকা ছবি দেখে মুগ্ধ হন, আনন্দে বুক ভরে ওঠে ছবিওয়ালার।
তবে আইপিএলের মরশুম তো সারা বছর থাকে না। সেই সময়টা কীভাবে কাটে ছবিওয়ালার? উত্তরে কিছু ঘটনার কথা জানালেন শুভজিৎ। যা অনায়াসে প্রমাণ করতে পারে, স্রেফ ক্রিকেটের নয় তিনি সত্যিকারের ছবিওয়ালা। সোশাল মিডিয়ায় প্রায়শই বিভিন্ন ট্রেন্ড দেখা যায়। এর মধ্যে জনপ্রিয় এক ট্রেন্ড হল, ‘ড্র আ স্ট্রেঞ্জার’। অর্থাৎ রাস্তাঘাটে একেবারে অচেনা-অজানা কারও ছবি এঁকে তাঁকে উপহার দেওয়া। অপ্রত্যাশিত উপহার পেয়ে সেই অচেনা ব্যক্তির চমকে ওঠা! উজ্জ্বল চোখ, হাসিমুখ, অস্ফুটে ধন্যবাদ বলা, সবটাই রিল বানিয়ে পোস্ট করা। তাতে লাইকের বন্যা বয়। শুভজিৎ ঠিক সেই কাজটাই করেন। তবে স্রেফ লাইকের আশায় নয়, ভালোবেসে। বাসে, ট্রামে তো বটেই, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা অচেনা অনেকের ছবি আঁকেন শুভজিৎ। কোনও প্রতিবন্ধী মন্দিরের গেটের সামনে ভিক্ষা চাইছেন, সেই দৃশ্য খাতায় ফুটিয়ে তুললেন ছবিওয়ালা। সেই ছবি উপহার দিলেন ভিক্ষুককে। আনন্দে বাকরুদ্ধ হলেন তিনি। কিংবা কেকের দোকানে ব্যস্ত দোকানিকে এঁকে ফেললেন কয়েক মিনিটে। তিনিও আনন্দে আত্নহারা হলেন। এমনই কতশত ঘটনার সাক্ষী থাকেন এই ছবিওয়ালা। ওই হাসি, ওই আনন্দে ভরা চোখই, তাঁর প্রাপ্য। তবে আইপিএলের মরশুমটা মোটের উপর ইডেনের বাইরেই কাটান শুভজিৎ। পথচলতি অনেকে দাঁড়িয়ে তাঁকে দেখেন, তাঁর সৃষ্টি দেখেন, ছবি তোলেন, উৎসুক চোখে জিজ্ঞাসা করেন। ছবি আঁকতে আঁকতেই উত্তর দেন শুভজিৎ। এতটুকু বিরক্তি নেই। কেউ বাঁকা কথা বললেও গায়ে মাখেন না।
কখনও কাউকে উপহারও দিয়ে দেন নিজের আঁকা ছবি। এভাবেই ভবিষ্যতে একদিন বিরাট-রোহিতের মতো ক্রিকেটারদের হাতে নিজের আঁকা ছবি তুলে দেবেন, এমনটাই তাঁর স্বপ্ন। বিশ্বাস করেন, একদিন তা সত্যি হবেই। সেই গৌতম গম্ভীরের বলা কথাগুলো মেনে চললে, সত্যি হবেই।