পাকিস্তানে তৎকালীন জেনারেল জিয়া-উল-হকের নেতৃত্বে হওয়া এক সামরিক অভ্যুত্থান ভয়াবহ আঘাত হেনেছিল জনসাধারণের অধিকারের উপর। দেশটি তার নিজস্বতা হারিয়ে দ্রুত এক ধর্ম-চালিত রাস্ট্রে পরিণত হচ্ছিল। এমন অবস্থায় দাঁড়িয়ে ১৯৭৯ সালে কবি ফায়েজ আহমেদ ফায়েজ লিখেছিলেন ‘হাম দেখেঙ্গে’, যেখানে সরাসরি প্রশ্ন তোলা হয়েছিল জিয়া-উল-হকের একনায়কত্বের উপর। এমন রাষ্ট্রের আগামী যে লেখা হবে সাধারণের হাতেই, তারও আভাস দিয়েছিল কবিতাটি।
মানুষকে সীমান্তের বিভাজন দিয়ে আলাদা করা গেলেও, গানের সুরকে করা যায় না বোধহয়। বন্যার জলের মতো তা প্রবেশ করে প্রতিটি আনাচে-কানাচে। আলোকিত করে তোলে হৃদয়ের সবচাইতে গোপন কুঠুরিও। অথচ যা কিছু স্বতঃস্ফূর্ত, বৈপ্লবিক, তাকে যেন স্বীকৃতি দিতে বরাবরই বাধে মানুষের পৃথিবীর। তাই কয়েক দশক ধরে মানবাধিকারের ধ্বনি তোলার পরেও, কেবল পাকিস্তানি শিল্পীর সৃষ্টি হওয়ার কারণে কোপ নেমে আসে ‘হাম দেখেঙ্গে’ গানটির উপর।
অভিনেতা তথা অ্যাক্টিভিস্ট বীরা সতীধরের স্মৃতির উদ্দেশ্যে স্মরণসভার আয়োজন হয়েছিল নাগপুরে। সেখানেই একদল তরুণ সমাজসেবী গেয়ে ওঠেন ফায়েজ আহমেদ ফায়েজের লেখা ‘হাম দেখেঙ্গে’। গত কয়েক বছরে ভারতে তরুণ সমাজের বিপ্লবের ভাষার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছে এই গানটির নাম। যা এক সময়ে রচনা হয়েছিল তৎকালীন পাক শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে, তা হয়ে উঠেছে প্রত্যেক শোষিতের ভাষা। স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে নিজের হক চেয়ে নেওয়ার জন্য সাধারণ মানুষ বেছে নিয়েছে এই গানটিকেই। অথচ এদিনের অনুষ্ঠান শেষ হতে দেখা যায়, পাকিস্তানি শিল্পীর লেখা এই গানটির উপর দেশদ্রোহিতার অভিযোগ করা হয়েছে স্থানীয় পুলিশের তরফে।
তাই ফিরতে হয় গানটির সৃষ্টির গল্পে। জন্মলগ্নে কবিতা আকারে লেখা হয়েছিল ‘হাম দেখেঙ্গে’, তখনও তাতে সুর জোড়া হয়নি। পাকিস্তানে তৎকালীন জেনারেল জিয়া-উল-হকের নেতৃত্বে হওয়া এক সামরিক অভ্যুত্থান ভয়াবহ আঘাত হেনেছিল জনসাধারণের অধিকারের উপর। দেশটি তার নিজস্বতা হারিয়ে দ্রুত এক ধর্ম-চালিত রাস্ট্রে পরিণত হচ্ছিল। এমন অবস্থায় দাঁড়িয়ে ১৯৭৯ সালে কবি ফায়েজ আহমেদ ফায়েজ লিখেছিলেন কবিতাটি, যেখানে সরাসরি প্রশ্ন তোলা হয়েছিল জিয়া-উল-হকের একনায়কত্বের উপর। এমন রাষ্ট্রের আগামী যে লেখা হবে সাধারণের হাতেই, তারও আভাস দিয়েছিল কবিতাটি। যদিও এছাড়াও আরও বহু প্রতিবাদী কবিতা লিখেছিলেন ফায়েজ, তবুও সবচাইতে বেশি চর্চায় আসে এই কবিতাটি।
কেবল সৃষ্টিই নয়, ‘হাম দেখেঙ্গে’র যাত্রাপথে জুড়ে গিয়েছে আরও এক প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর, আর তা পাকিস্তানি গায়িকা ইকবাল বানোর। ১৯৮৬ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারি এক নতুন বৈপ্লবিক মাত্রা পায় ‘হাম দেখেঙ্গে’; যখন দর্শকে উপচে পড়া অডিটোরিয়ামে দাঁড়িয়ে কবিতাটিকে গানের আকারে পেশ করেন ইকবাল বানো। পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি দেশে মেয়েদের শাড়ি পরা নিষিদ্ধ করেছিল সে সময়ে, কারণ শাড়ি ভারতের মেয়েদের পোশাক। শাসক জিয়া-উল-হকের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ কবিতাটি বেছে নিয়েছিলেন ইকবাল বানো। প্রতিবাদ স্বরূপই স্টেজে দাঁড়িয়ে গান করার সময়ে পোশাক হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন একটি কালো শাড়ি। অডিটোরিয়াম সেদিন ফেটে পড়ছিল মানুষের ভিড়ে। অনুষ্ঠান শেষের পরে আরও একবার ‘হাম দেখেঙ্গে’ গাইতে অনুরোধ করা হয় গায়িকাকে। শোনা যায়, সে রাতে নাকি শাসক গোষ্ঠীর লোকেরা এই অনুষ্ঠানের আয়োজকদের বাড়িতে বাড়িতে হামলা চালায়।
এর বেশ কিছু বছর পর, একেবারে হাল আমলে এসে ভারতের যুবার কাছে নতুন করে জনপ্রিয়তা পায় গানটি। সে গানই গাইতে গিয়ে যে এমন বিপাকে পড়তে হতে পারে নাগপুরের তরুণ সমাজসেবীদের, তা হয়তো কল্পনাও করতে পারেননি তাঁরা। তবে এ যেন ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি। বর্তমান সময়ে যে যেকোনওরকম পাকিস্তানি যোগসূত্রকে ছিন্ন করতে উদ্যত ভারত, সেখানে যে এ গানের উপরেও ক্ষোভ নেমে আসবেই, তা আর অবাক করে না। তবে বাক স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ কিংবা শিল্পের নির্দিষ্ট দেশ নির্ধারণ করাও কি এক প্রকার স্বৈরাচারেরই ইঙ্গিত বহন করে না? প্রেম কিংবা বেদনার মতো বিপ্লবও যে স্বতঃস্ফূর্ত, মানুষের অধিকারের লড়াইকে যে সীমান্ত দিয়ে বেঁধে ফেলা সম্ভব নয়, তা হয়তো সময় বিশেষে ভুলে যায় শাসকদল। আর এখানেই সফল হয়ে যায় গানটি। যুগে যুগে বারে বারে শাসকের চোখে চোখ রেখে বলে যায় ‘হাম দেখেঙ্গে…!”