যাত্রা শুরু করেছিলেন ২০২২ সালের ১ নভেম্বর। এই মার্চ মাসের মাঝামাঝি তাঁর ঘোরা হয়ে গিয়েছে ভারতের ১৮টি রাজ্য। আর পুরোটাই বিনা পয়সায়। যাত্রাশুরুর সময় জানতেন না। কিন্তু চলতে চলতে তিনি জানতে পারেন এই চ্যালেঞ্জ নিয়ে এখন অনেকেই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছেন। তাঁদের কয়েকজনের সঙ্গে দেখাও হয়ে গিয়েছে তাঁর। তিনি সরস্বতী আইয়ার। আসুন শুনে নিই তাঁর এই ব্যতিক্রমী ভারত-ভ্রমণের গল্প।
গত চার মাসে তিনি ঘুরে ফেলেছেন জম্মু-কাশ্মীর, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, পাঞ্জাব, মহারাষ্ট্র, ওড়িশার মতো রাজ্য। সঙ্গে কেউ নেই। নেই বিশেষ টাকাপয়সাও। তবু নিজের দেশকে চেনার নেশায় তিনি মশগুল। এই কিছুদিন আগে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে চলছিল ভারত-জোড়ো-যাত্রা। আর সরস্বতীর একক উদ্যোগে যেন চলছে ভারতকে চেনার যাত্রা। একলা একজন তরুণীর এই বিনা পয়সায় ভারতভ্রমণ রীতিমতো বিস্মিত করেছে সকলকে।
আরও শুনুন: একটি গাছের পরিচর্যায় খরচ ১২ লক্ষ টাকা, দিনরাত পাহারা দেয় সশস্ত্র প্রহরী, কেন জানেন?
তা কীভাবে শুরুটা হয়েছিল? বলতে গেলে খুবই সাদামাটা ভাবে। হাতে ছিল একটা কাগজ, যার একপিঠে লেখা ‘লিফট’, আর অন্যদিকে বড় করে হিন্দি ও ইংরাজিতে লেখা ‘অল ইন্ডিয়া ট্রাভেল’। সঙ্গে তাঁর ইউটিউব চ্যানেলের আইডি, ‘ট্রাভেল উইথ আইয়ার’। প্রথমদিকে শুধু এটুকু দেখিয়েই গাড়িতে ‘লিফট’ চেয়ে এগোনো শুরু সরস্বতী আইয়ারের। এরপর যাত্রা শুরুর ৩০-৪০ দিন পর থেকে সরস্বতী এই যাত্রার ছোট ছোট ভিডিও করে তাঁর ইউটিউওব চ্যানেলে পোস্ট করতে শুরু করেন। আর সেখান থেকেই তাঁর এই বিনা পয়সায় দেশ ঘোরার কথা ছড়িয়ে পড়তে থাকে নেট-নাগরিকদের মধ্যে। ফলে গাড়িতে লিফট পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, কারও কারও বাড়িতেও আতিথেয়তা গ্রহণের নিমন্ত্রণ আসতে থাকে। তাঁর ইউটিউওব ভিডিও দেখে, দেশের বিভিন্ন রাজ্য থেকে মানুষজন তাঁকে নিজেদের রাজ্যে ঘুরে যাওয়ার কথা বলেন। তাঁদের রাজ্যে গিয়ে অতিথি হওয়ার অনুরোধ করেন। নির্দিষ্ট কোনও জায়গা থেকেই তাঁরাই সরস্বতীকে গাড়ি করে নিয়ে যান তাঁদের বাড়িতে। তাঁদের পরিবারের সঙ্গেই সময় কাটান, কিছুক্ষণ বিশ্রাম করেন, খাবার খান, কেটে যায় রাতটুকুও। পরদিন ভোর হতেই আবার রওনা।
আরও শুনুন: রাস্তাঘাটে আর লাগবে না গাড়িভাড়া! কোন দেশে রয়েছে এমন অদ্ভুত সুযোগ?
এইসব বাড়ি থেকেই পরিবারের গুরুজনেরা কখনও সঙ্গে দেন তাঁদের রাজ্যের কোনও বিশেষ জিনিস, তাঁদের হাতে বানানো খাবার-দাবার। আর সকলের আশীর্বাদ তো আছেই। তবে ভাগ্যদেবতা যে সবসময় সরস্বতীর উপর প্রসন্ন হন, তা নয়। সেইসব দিনে শুকনো নান বা পেঁয়াজ কুচি দিয়ে রোল বানিয়ে খেয়ে নিতে হয় সরস্বতীকে। ট্রাকের সামনে, ড্রাইভার আর হেল্পারের পাশে বসে, টানা ৭০০ কিলোমিটার পথ পার হতে হয়। তবে এমন দিনগুলোতেও সোনামুখ করে ভালবেসেই তাঁর যাত্রা ভিডিওতে ধরে রাখেন সরস্বতী। কারণ তিনি জানেন, যে রাস্তায় তাঁর এগিয়ে যাওয়া সেখানে একজন সঙ্গীও যদি পাওয়া যায়, তবে তা ভাগ্যের ব্যাপার। আরও কয়েকটি জিনিস যাচাই করে নিতে হয় সরস্বতীকে, লিফটের গাড়ি যিনি চালাচ্ছেন তিনি সুস্থ আছেন কি না বা নেশাগ্রস্ত কি না। রাতটুকু যেখানেই কাটুক পরদিন ভোর ভোর আবার যাত্রা শুরু করে দিতে হবে। নাহলে রাস্তায় গাড়িতে লিফট পাওয়া মুশকিল হতে পারে। সঙ্গের বোঝাও যথাসম্ভব হালকা রাখাই নিয়ম এসব ক্ষেত্রে। আর আগে থেকে সব দেখেশুনে ঠিক করে নিতে হবে যাত্রাপথও। কারণ গাড়ি পেলেই হবে না, সেটা কতটা যাবে, সেখান থেকে এগোনো যাবে কীভাবে এসব ভেবে নিতে হয়। অনেক সময়ই তাই গাড়ি পেতে অনেক দেরিও হয়ে যায়। তখন হাইওয়ে বরাবর হাঁটতে থাকেন সরস্বতী। কারণ হাইওয়ের কাছাকাছি থাকলে গাড়িতে লিফট পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। কোনও লং রুটের গাড়ি না পাওয়া গেলে মাঝখানে কোথাও আবার থামা, জায়গা খোঁজা, কখনও নিজের পিঠে বয়ে চলা টেন্ট বিছিয়েই রাত্রিবাস। আবার ভোর হতেই হয়ত, একেবারেই নাম-গোত্রহীনের মতো পরবর্তী কোনও রাজ্যের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়া।
আরও শুনুন: মায়ের স্বপ্ন পূরণ করল ছেলে, স্ট্রেচারে শুয়েই তাজমহল দেখলেন ৮৫ বছরের বৃদ্ধা
সরস্বতীর এই ভারতভ্রমণ শুধু শখপূরণ নয়। বরং এই ভ্রমণ আসলে এক বার্তাও। এদেশে মেয়েদের একা এরকম বেরিয়ে পড়া যে চিন্তার কোনও বিষয় নয়, এবং স্থানীয় অনেক মানুষই যে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন সে কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে তাঁর যাত্রাপথ। মনে করিয়ে দিচ্ছে দেশের মানুষ আজও অতিথিকে নারায়ণ জ্ঞানেই সেবা করেন। তাঁর এই যাত্রা মনে করিয়ে দেয় এ-দেশেরই আরেক মেয়ে আশা মালব্যর কথা। সাইকেল চড়ে তিনি গোটা ভারত ঘুরে একটা বার্তাই দিতে চেয়েছিলেন, এ দেশ নারীদের জন্যেও। হয়ত সেই ভরসাতেই সরস্বতীও বেরিয়ে পড়েছিলেন সামান্য কিছু জিনিস সঙ্গে নিয়ে। ইচ্ছে আর মানুষের উপর ভরসা থাকলে আজও অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়, টাকা-পয়সা সেখানে বড় কোনও ব্যাপারই নয়, প্রতি পদক্ষেপে যেন এই বার্তাই তুলে ধরছেন সরস্বতী।