চটুল বিনোদন নয়। চ্যানেলের কনটেন্ট কৃষি সংক্রান্ত আলোচনা। তার সঙ্গে পশুপালন। দায়িত্ব নিয়ে তা করেন, মধ্যপ্রদেশের রাম। নতুন প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে কীভাবে চাষের উন্নতি করা যায়, সেসব নিয়েই আলোচনা করেন তিনি।
ইউটিউব যেন সব পেয়েছির দেশ। অপারেশন থেকে জুতো সেলাই, সব শেখা যায় সেখানে। তাই বলে চাষবাস কিংবা গরুর পালনের পদ্ধতিও শেখা যাবে? জনপ্রিয় ইনফ্লুয়েন্সর (Social Media Influencer) বলছেন আলবাত যাবে। কারণ দায়িত্ব নিয়ে সেই কাজ করছেন তিনি। সে প্রসঙ্গে আসার আগে একটু পিছন ফিরে দেখা যাক।
ভারতে টিভি আগমনের ১০০ বছরও পেরোয়নি। এরই মধ্যে দেশের অন্যতম শক্তিশালী গণমাধ্যম হিসেবে নিজের জায়গা পাকা করেছে টেলিভিশন। যুগের সঙ্গে তার আকারে বহরে বেজায় পরিবর্তন এসেছে। ভাষা বদলেছে, অনুষ্ঠানের ধরন বদলেছে, বদলেছে আরও অনেক কিছুই। টিভির অনুষ্ঠান চাইলেই মোবাইলে দেখে নেওয়া যায়। এতশত আধুনিকতার মাঝে টেলিভিশনের সেই পুরনো আমেজ, অন্তত বিশেষ এক অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে, ফিরে এসেছে। এবং তা ফিরিয়ে এনেছেন মধ্যপ্রদেশের রাম পারমার। সামাজিক পরিচয়, ইনফ্লুয়েন্সর (Social Media Influencer)। তবে চটুল বিনোদন নয়, তাঁর কাজ অনেকটা কৃষিকথার অনুকরণ বলা যায়।
একসময় ছোট ছোট গ্রামে একটাই টেলিভিশন থাকত। কার বাড়িতে, জানার প্রয়োজন নেই। সবাই এটুকু জানত, চাইলেই সেখানে গিয়ে টিভি দেখা যাবে। অনুমতির প্রয়োজন নেই, কেউ কিছু মনেও করবে না। বরং দল বেঁধে টিভি দেখতে যাওয়াই আনন্দের। যদিও স্রেফ আনন্দ নয়, এই টিভি দেখায় শিক্ষাও মিলত ঢের। যে সময়কার কথা বলছি তখন সারাদিন ধরে টিভিতে অনুষ্ঠান চলত না। চ্যানেলের সংখ্যাও ছিল হাতে গোনা। দিনের নির্দিষ্ট সময় তাতে খবর বা বিশেষ কিছু অনুষ্ঠান হত। আর সেইসব দেখতেই ভিড় জমাতেন গোটা গ্রামের মানুষ। এমনই এক অনুষ্ঠান ‘কৃষিদর্শণ’। আদতে চাষবাস নিয়ে আলোচনা। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে কথা বলতেন সঞ্চালক। কথা হত মূলত কৃষিকাজ এবং গরু-ছাগল জাতীয় গৃহপালিত পশুপালন নিয়ে। চাইলেই চিঠি পাঠিয়ে নিজেদের সমস্যার কথা জানাতে পারতেন কৃষকরা। আলোচনায় উঠে আসত সমাধান। এরপর অনেকগুলো বছর পেরিয়েছে। চাষবাস থাকলেও কৃষিদর্শণের মতো অনুষ্ঠান আর কেউ দেখে না। অন্তত জনপ্রিয়তার নিরিখে তো বটেই। একথা বললে খুব একটা ভুল হয় না যে, একসময় এই অনুষ্ঠানের ভরসায় চাষবাস করতেন বহু কৃষক। সবসময় বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে সরাসরি পরামর্শ নেওয়া সম্ভব হত না, সেক্ষেত্রে বিশেষ কাজে দিত এই অনুষ্ঠান। ঠিক যেমনটা এখন কাজে দিচ্ছে, ‘ফারমার্স চয়েস’!
কী ভাবছেন টিভির অনুষ্ঠান?
আজ্ঞে না। এটি ইউটিউবের জনপ্রিয় এক চ্যানেল। যার পরিচালক মধ্যপ্রদেশের রাম। আজকাল সোশাল মিডিয়ায় ভ্লগ করা বেশ ট্রেন্ডিং বিষয়। তবে সমস্যাও ওই বিষয় নিয়েই। জনপ্রিয়তার লোভে অনেকসময় কনটেন্ট ক্রিয়েটররা (Social Media Influencer) এমন কিছু করছেন, যা ভাবতে বাধ্য করছে সুশীল সমাজকে। আলোচনা, সমালোচনা সব হচ্ছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এই ধরনের কনটেন্ট। চটুল বিনোদন, এমন কটাক্ষও অনেকেই করে থাকেন। তাতে লাভের লাভ কিছু হয় না। এসবের ভিড়ে রাম ব্যতিক্রম। চ্যানেলের নাম থেকেই বোঝা যায় বিষয়টা কী! ঠিক ধরেছেন, একেবারে কৃষিদর্শণের ধাঁচেই চাষবাসের কথা আলোচনা করেন রাম। একইসঙ্গে পরামর্শ দেন গরু পালন নিয়েও। তাঁর বাড়িতেও ‘গির’ প্রজাতির একটি গরু রয়েছে। তার পরিচর্যা, দেখাশোনা কীভাবে করেন, সেইসব ভিডিও আকারে প্রকাশ করেন রাম। বই পড়ে বুঝে নেন ছোটখাটো সমস্যার সমাধান। সেসব নিয়েও ভিডিও করেন। আসলে, ছোট থেকেই কৃষিকাজ এবং সেই সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা শুনেছেন রাম। তাঁর পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও বিষয়টা গুরুত্ব দিয়েই দেখেন। রাম অবশ্য এর সঙ্গে বিজ্ঞানের নয়া প্রযুক্তির মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। কীভাবে চাষ করলে আরও ভালো হবে ফলন, সেসব বিভিন্ন জায়গা থেকে খোঁজখবর নিয়ে জানার চেষ্টা করেন রাম। উদ্দেশ্য একটাই, ভিডিও বানিয়ে সবাইকে সচেতন করা।
প্রাথমিক ভাবে মনে হতে পারে, এইসব চাষবাসের ভিডিও কে দেখে? উত্তরটা মিলবে একবার ওই চ্যানেলে ঢুঁ মারলে। হাজার হাজার ফলোয়ার্স, লাখ লাখ ভিউ, এসব একেবারে সহজ বিষয় হয়ে উঠেছে রামের কাছে। প্রথম প্রথম অবাক হতেন বইকি, কিন্তু সময়ের সঙ্গে বুঝেছেন এসব দেখার দর্শকও রয়েছেন। সেই সংখ্যাটাও নেহাত কম নয়। তাই বলে সমস্যাও কম হয়নি। প্রথম রাম গ্রামের ছেলে, সেই সুবাদে তথাকথিত চাকরি বা ব্যবসা ছেড়ে ইউটিউবে ভিডিও বানানো (Social Media Influencer) তাঁর কাছে বেশ চ্যালেঞ্জের ছিল। এছাড়া গ্রামের অনেকেই বিষয়টাকে বাঁকা নজরে দেখেন। সময় নষ্ট হচ্ছে, এমন কটাক্ষও সহ্য করতে হয়েছে। তবে নিজের লক্ষে অবিচল ছিলেন রাম। একদিনে সাফল্য আসেনি, কিন্তু যখন এসেছে তখন পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি আর। স্রেফ ইনফ্লুয়েন্সর হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করাই রামের লক্ষ্য ছিল না, বরং কৃষকদের সচেতন করার মানসিকতা নিয়েই কাজ শুরু করেছিলেন। তাতে সাফল্য পেয়ে নতুন উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে যেতে চান। রোজগারও মন্দ হয় না। যে দেশের মূল ভিত্তি কৃষিকাজ, সেখানে এমনটা হওয়া যে অস্বাভাবিক নয় তা বলাই যায়। তবু বর্তমান সমাজ ইনফ্লুয়েন্সরদের যে সংজ্ঞা তৈরি করেছে, তাতে রাম একেবারেই বসেন না। তাই আলোচনার কেন্দ্রে তিনি। আগামীতে এইভাবে দেশের সব কৃষকের কাছে পৌঁছানোর স্বপ্ন দেখেন রাম। তাতে স্রেফ তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়বে না, লাভ হবে সেই কৃষকদেরও।