ভোট প্রচারে ধর্ম যত বড় ইস্যুই হোক না কেন, ইভিএমে বোতাম টিপে ভোট দেওয়ার নিতান্ত যান্ত্রিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ধর্মের যোগাযোগ নেই। কিন্তু সেই নির্বাচনী আবহেই দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক নেতৃত্বের সংলাপে ধর্মের যে অনুষঙ্গগুলি উঠে আসছে, তাতে ভোটের চেনা হাওয়াটাই যেন বদলে যাচ্ছে।
রাজনীতির হিসেব কষা অঙ্কে কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল, তা নিয়ে কথা চলতেই পারে। কিন্তু ঠিক ভুল নয়, একেবারে পাপ আর পুণ্যের খতিয়ান? সে তো নিতান্তই ধর্মের কনস্টিটুয়েন্সি, অর্থাৎ কিনা নির্বাচনী এলাকা। হিসেবমতো তো এ দুয়ের মধ্যে যোগ থাকার কথা নয়। তবে সাম্প্রতিক কালের ভোটবার্তায় সেই পার্থক্য গুলিয়ে যেতে পারে সহজেই। কেননা ভোটের প্রসঙ্গেই অহরহ পাপ পুণ্যের হিসেবনিকেশ কষছেন নেতারা। উঠে আসছে প্রায়শ্চিত্তের প্রসঙ্গও। সব মিলিয়ে মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়, কোনও প্রশাসনিক নির্বাচন চলছে, নাকি পঞ্জিকা মেনে কোনও শাস্ত্রীয় ধর্মের আচার?
আরও শুনুন:
প্রেমের পথে রাজনীতি কাঁটা, কী ভাবছেন ভারতীয় যুগলরা?
তা যদি বলা হয়, রাজনীতির মধ্যে ধর্মের আনাগোনা কিন্তু নতুন নয়। চার্চ আর রাজা, কার ক্ষমতা বেশি, তা নিয়ে ঠান্ডা লড়াই চলেছে ইউরোপে। মিশরে তো রাজাকে সরাসরি দেবতার সন্তান বলেই ঘোষণা করা হত। প্রাচীন ভারতবর্ষেও রাজতন্ত্রের আমলে রাজা আর পুরোহিতেরা হাত ধরাধরি করেই চলেছেন। তবে আধুনিক যুগে গণতান্ত্রিক দেশে তো আর রাজা নেই। রাজনীতিতে ধর্ম প্রসঙ্গ আছে বটে। বিজেপির আমলে সংসদ ভবন প্রতিষ্ঠার দিনেও দেখা গিয়েছে সাধু সন্ন্যাসীদের ভিড়, একইভাবে রাম মন্দিরে রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠা প্রায় রাজনৈতিক ইভেন্টের রূপ নিয়েছে। তবে ভোট প্রচারে ধর্ম যত বড় ইস্যুই হোক না কেন, ইভিএমে বোতাম টিপে ভোট দেওয়ার নিতান্ত যান্ত্রিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ধর্মের যোগাযোগ নেই। কিন্তু সেই নির্বাচনী আবহেই দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক নেতৃত্বের সংলাপে ধর্মের যে অনুষঙ্গগুলি উঠে আসছে, তাতে ভোটের চেনা হাওয়াটাই যেন বদলে যাচ্ছে।
সম্প্রতিই পুরীর বিজেপি প্রার্থী সম্বিত পাত্রর সমর্থনে রোড শো করেছেন নরেন্দ্র মোদি। সেই আবহেই খোদ জগন্নাথদেবকে মোদির ভক্ত বলে বসেন সম্বিত। জগন্নাথপ্রেমী ওড়িশাবাসীরা এ মন্তব্যকে আদৌ ভালোভাবে নেননি। সুতরাং সেখান থেকে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে সম্বিত জানিয়েছেন, এই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করবেন তিনি। টানা তিনদিন উপবাস করেই নিজের দোষ ক্ষালন করতে চান নেতা। উপবাস একেবারেই ধর্মীয় ব্রত-আচারের সঙ্গে জড়িত। আর প্রায়শ্চিত্তও তো আসে পাপের প্রসঙ্গেই। শুধু সম্বিতই নন, ভোটপ্রচারে পাপের কথা বলেছেন খোদ মোদিই। তাঁর বক্তব্য, দেশের পিছিয়ে পড়ার জন্য দায়ী ইন্ডিয়া জোটের পাপ। রাজনীতিকরা জানেন, পাপের প্রসঙ্গ টানায় এর আগেও বিতর্ক ঘনিয়েছে দেশের রাজনীতিতে। স্বাধীনতার আগে যখন কংগ্রেস, মুসলিম লিগের মতো দলগুলি প্রতিষ্ঠা পেয়ে গিয়েছে, সে সময়ে গান্ধীজিকে বলতে শোনা গিয়েছিল, বিহারের ভূমিকম্প হরিজনদের পাপের ফল। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ে যে কোনও রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য হওয়ার কথা বিপন্নদের ত্রাণ, এবং পরবর্তী কালে এহেন দুর্যোগের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রাখা। সেখানে কোনও রাজনৈতিক নেতার মুখে ‘পাপ’ প্রসঙ্গ উঠে আসায় অবাকই হয়েছিলেন সকলে। এতদিন পরে সেই বিহারেই যে প্রসঙ্গে ‘পাপ’-এর কথা তুললেন মোদি, সেখানেও তার সাযুজ্য কোথায়? কোনও রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাঁর বিরোধীদের ভুল ত্রুটি নিয়ে সমালোচনায় মুখর হতেই পারেন। কিন্তু তিনি যাকে ভুল বা অনুচিত বলে মনে করছেন, তাকে ‘পাপ’ বলে দাগিয়ে দিয়ে একরকম ধর্মীয় অনুষঙ্গকেই তিনি টেনে আনছেন বইকি। দিনকয়েক আগে রাজ্যপাল ও শ্লীলতাহানি প্রসঙ্গে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কটাক্ষ করেছিলেন, রাজ্যপালের পাশে বসাও পাপ। আবার এর আগে সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-এর গঙ্গাসাগরে যাওয়াকে নিশানা করেই বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ বলেছিলেন, প্রতি নির্বাচনের পর পাপ ধুতে যান তিনি। অর্থাৎ এখানেও সেই প্রায়শ্চিত্তের ইঙ্গিত।
আরও শুনুন:
যে রাঁধে সে রাজনীতিও করে! ভোটের হাওয়ায় পলিটিক্সের হেঁশেলনামা
সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, বারেবারেই ভোটের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে পাপ বা প্রায়শ্চিত্তের মতো শব্দগুলি। রাজনৈতিক তর্ক নয়, বিরোধিতার টানাপোড়েন নয়, একে অপরের দিকে যেন ধর্মের আঁচড় কেটে যাচ্ছেন নেতানেত্রীরা। আর সেই মানচিত্রে ভোটও যেন ক্রমে পথ হারাচ্ছে, তার চেহারাও হয়ে দাঁড়াচ্ছে পঞ্জিকায় বাঁধা শাস্ত্রীয় ধর্মকর্মের মতোই।