Duck মানে শূন্য, কিন্তু সরস্বতীর পড়ুয়া হাঁস ক্লাসে ফার্স্ট। অবশ্য সে ভালো পড়ুয়া হবে না-ই বা কেন, এই একমাত্র প্রাণীর কাছেই বোধহয় এত বিচিত্র বই ডাঁই হয়ে জমে থাকে। আর সেসব বই বেশিরভাগই তো সিলেবাসের। সিলেবাসে বসবাসের একঘেয়েমি কাটিয়ে এবার কি অন্য বই পাবে সে? সরস্বতী পুজোর হাওয়ায় সেই হাঁসকেই খুঁজেপেতে তার কথা শুনলেন সম্বিত বসু।
অলংকরণ: অর্ঘ্য চৌধুরী
বই দিলে, একজনই তড়িঘড়ি ফেরত দিয়ে দেন। তিনি সাক্ষাৎ সরস্বতী। আর তাঁরই বাহন– হাঁস। সাদা, নরম। শৈশবের ‘ডাক টেলস’ কমিকসের সঙ্গে তার কৌতুকগত কোনও মিল নেই। বরং, একটা শান্ত-শুভ্র, ক্লাস ওয়ান থেকে সেভেন পর্যন্ত নিরন্তর ফার্স্ট হয়ে চলেছে, এমন কেউ। এবং সাদাটেপনায় বোঝা যায়, ড্রেস কোডের ব্যাপারে তারা ভারি তীক্ষ্ণ, লোকাল গার্জেনের রক্ষচক্ষু ও ইশকুলের নিয়মনীতি ডাহা মেনে চলে। ইয়ার্কি মোটে পছন্দ করে না, হাঁস আগে না ডিম আগে– এই প্রশ্ন করলে নির্ঘাত গৌতম গম্ভীরের মতো সে বলে বসবে: সরস্বতী আগে।
তার একমাত্র সমস্যা– আঙুলমোজা পরতে পারে না। সাঁতারে প্রথম, কিন্তু বাকি সব খেলায় ন্যাজেগোবরে। অবশ্য সে ভালো পড়ুয়া হবে না-ই বা কেন, এই একমাত্র প্রাণীর কাছেই বোধহয় এত বিচিত্র টাইপের বই ডাঁই হয়ে জমে থাকে। আর সেসব বই বেশিরভাগই তো সিলেবাসের। আমি বলি কী, মাঝে মাঝে অন্য বইপত্তরও
একটু দিয়ে রাখুন। শুধু সিলেবাসের বই পড়লে ওর বোরিং লাগবেই। আর সেই তো এক সিলেবাস, থোড়-বড়ি-খাড়া– খাড়া-বড়ি-থোড়। কোনদিন ‘ধোর’ বলে ঊর্ধ্বতন সরস্বতীকে যদি বলে বসে, এ চাকরি আর পোষাচ্ছে না বাপু, আমাকে ক্ষান্ত দিন, তখন কিন্তু ব্যাপারখানা ঝুলে একশা! পিডিএফও দিতে পারেন, তবে যা গ্যাজেটপ্রেম উথলে উঠছে বাঙালির, তাতে এ ব্যাপারটা কাটিয়ে দেওয়াই ভালো।
তার চে’ আপনি একটু হার্ডবাউন্ড বিভূতিভূষণ দিলেন, লীলা মজুমদার দিলেন। পরের বছর তারাপদ রায়, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। তার পর হয়তো মার্কেজ আর কুন্দেরা। অতঃপর শিবরাম চক্রবর্তী আর সুকুমারী ভট্টাচার্য। এরকম গোছের একটা লিস্ট বানালে দেখবেন, ভালোই লাগবে। হতেই পারে, স্কুল-কলেজ উত্তীর্ণ আপনি, হয়তো বা বিরাট বিপুল চাকরি-বাকরিও করেন, তাই বলে হাঁসেদের জন্য একটু ভাববেন না! তারাই তো ওপরতলা পর্যন্ত আপনার বইখানা মন্ত্রপূতঃ করে দিল। শুধু এটুকুই দেখবেন, রেসিপির বই যদি দেন, তাতে হাঁসের ডিমের ডালনা কিংবা ডাক রোস্ট যেন না থাকে, নইলে এই ডাক-ব্যবস্থা উঠে যাবে।
ক্রিকেট খেলা দেখতে বসে যদিও হাঁসেদের ব্যাপারে অন্য একখানা অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তা হল, কোনও ব্যাটার যদি শূন্য রানে আউট হয়ে গগনপানে তাকিয়ে হেলমেটে গ্লাভস পুরে হাঁটা লাগান, তার একটা দুঃখিত গ্রাফিক অনুবাদ ছিল হাঁসের মাধ্যমেই। হতাশ, হতাশ্বাস, মাথা নিচু করা এক হাঁস, টেলিভিশনের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে হাঁটা লাগাত। সম্ভবত দু-এক ফোঁটা অশ্রুও ঝরে পড়ত সেই হাঁসের চোখ থেকে। বুঝেইছিলাম, ডাক-এর আরেক অর্থ শূন্য। ভেবে দেখুন, সরস্বতীর পায়ের গোড়ায় শূন্য, আর আমাদের প্রার্থনা– নম্বরে ভরিয়ে দিন! অবশ্য লোকে বলে, এই দিদিমণির বা ওই স্যরের হাতে নম্বর আছে। তার মানে পায়ে শূন্য, হাঁটুতে পাশ মার্ক, পাঁজরে ফার্স্ট ডিভিশন, আর হাতে বোধহয় নম্বরের ফুলঝুরি।
খাস সুকুমার রায় হাঁসকে নানা লেখায় টেনেটুনে এনেছেন বটে, সেসব লেখা লোকে মনেও রেখেছে। কিন্তু হাঁস তেমন একটা বিখ্যাত হতে পারেনি, যতটা তার হওয়ার কথা। ‘হ য ব র ল’-এর সেই বিখ্যাত বেড়াল বলে উঠেছিল, ‘ছিল একটা ডিম, হয়ে গেল দিব্যি একটা প্যাঁকপ্যাঁকে হাঁস। এ তো হামেশাই হচ্ছে।’ এই ‘হামেশাই হওয়া’ কি হাঁসের উঠতি ভবিষ্যতে হাতুড়ি মেরে দিল? এমনকী, ভাবুন, ‘হাঁসজারু’ ব্যাপারখানা যতটা হিট করল, একলা হাঁস নিজের সিনেমাখানা টানতে পারল না। যদিও লোককথা বা পঞ্চতন্ত্রর কাহিনিতে হাঁসেরা বেজায় পরিমাণে ভিড় জমিয়েছে। তবু বাঘা বাঘা সম্পাদককুল কেবলই হাসির গল্প সংকলন বের করে চলেছেন, হাঁসের গল্প সংকলন হতে মোটেই দেখা যায়নি– সে যতই সরস্বতীর বাহন হোক না কেন!
কিন্তু হাঁসকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন জীবনানন্দ, যদিও তা বুনো হাঁস, এই দেবী সরস্বতীর স্বচ্ছ বাহন নয়। তবু সেই কবিতায় কমিউনিটি হিসেবে হাঁসেরা খানিক শান্তি পেয়েছিল বইকি। ‘কল্পনার হাঁস সব; পৃথিবীর সব ধ্বনি সব রং মুছে গেলে পর/ উড়ুক উড়ুক তা’রা হৃদয়ের শব্দহীন জ্যোৎস্নার ভিতর।’ কল্পনার সেই হাঁস, সজাগ থাকুক। শিল্পের সত্য– সেই কল্পনার হাঁস। সে তত বিখ্যাত না হলেও চলবে, শুধু সুদূরতম পথ হয়ে থাক হাঁস চলার পথ। কল্পনার হাঁস চলার পথ।
অলংকরণ: অর্ঘ্য চৌধুরী