ছোটবেলায় কত কুনোব্যাঙ ধরেছেন তার ইয়ত্তা নেই। সেসব বিক্রি করে দিয়েছেন কটা টাকার লোভে। তবে সেই ‘রত্নাকর’ জীবন ছেড়ে একদিন তিনিই হয়ে উঠলেন বন্যপ্রাণী সংরক্ষণকর্মী। খুলে ফেলেছেন পশুপাখিদের জন্য গোটা একটি স্যাংচুয়ারি, যেখানে বাস তিনশোরও বেশি পশুপাখির। বন্যপ্রাণীদের বিষয়ে আজ খোলা পাঠশালা সেই অভয়ারণ্য। কেমন ছিল অ্যানিম্যাল অ্যাকটিভিস্ট সঞ্জীব পেদনেকারের সেই পথচলা? আসুন, শুনে নিই।
ছোট বেলায় এয়ারগান দিয়ে নাকি বিস্তর পাখি শিকার করেছেন সালিম আলি। সেই তিনিই পরবর্তীকালে হয়ে ওঠেন বার্ডম্যান অব ইন্ডিয়া, ভারতের অন্যতম পক্ষীবিদ। বেঙ্গালুরুর ছেলে সঞ্জীব পেদনেকারের গল্পটাও ছিল অনেকটা তেমনই। ছোটবেলায় কুনোব্যাঙ নর্দমা থেকে ধরে এনে সেগুলো এক টাকা-দু’টাকার বিনিময়ে স্থানীয় অ্যাকোয়ারিয়ামের দোকানে বেচে দিতেন। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, রত্নাকরেরাই বারবার হয়ে উঠেছে বাল্মীকি। সঞ্জীবের কাহিনিটাও আলাদা নয়।
আরও শুনুন: এলন মাস্ক বা আম্বানির নাম শোনা, কিন্তু বিশ্বের প্রথম কোটিপতি ব্যক্তিকে কি চেনেন?
সেই কবে থেকে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের দায়িত্ব পালন করে আসছেন তিনি। সরকারি কোনও রকম পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই খুলে ফেলেছেন একটি অভয়ারণ্যও, যেখানে নিরাপদে বাস করে তিনশোরও বেশি পশুপাখি। বন্যপ্রাণীদের বিষয়ে তাঁর বিপুল ভালবাসা ও জ্ঞানই ২৯ বছরের সঞ্জীবকে করে তুলেছে ভারতের অন্যতম অ্যানিম্যাল অ্যাকটিভিস্ট।
তবে সেই শুরুটা হয়েছিল আচমকাই। তখন সঞ্জীব নেহাতই ছোট। স্কুল পরিদর্শনে এসেছিলেন এমকে শ্রীনাথ নামে এক এডুকেশন অফিসার। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের ব্যাপারে প্রথম আগ্রহটা গড়ে দিয়েছিলেন তিনিই। সেদিন স্কুলে তিনি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন একটি কুমিরের ছানা আর একটা শঙ্খচূড় সাপ। পিকনিক বাস্কেটের ভিতরে প্রাণীদুটিকে দেখে তো ছাত্ররা অবাক। তবে শ্রীনাথ খুব যত্ন করে সেদিন বুঝিয়েছিলেন সরীসৃপ সম্পর্কে। তার আগে এমন প্রাণী কোনও দিন এত কাছ থেকে দেখেননি সঞ্জীব। শ্রীনাথের কথা শুনে অনুপ্রাণিত হন তিনি। শুরু হয় সরীসৃপ নিয়ে পড়াশোনা। বন্যপ্রাণীদের প্রতি ভাললাগাটাও বোধহয় শুরু হয়েছিল সেখান থেকেই।
আরও শুনুন: ৭৫ বছর পরেও টাটকা ভিটেমাটির স্মৃতি, ভিসা পেয়ে পাক মুলুকে যাচ্ছেন পুনের বৃদ্ধা
২০১৭ সালে এক একর জমি আর ৪০টি বন্যপ্রাণকে নিয়ে শুরু হয়েছিল তাঁর স্যাংচুয়ারি। একটা সময় বহু বিনিয়োগকারীর দরজায় দরজায় ঘুরতে হয়েছে। সেসময় প্রায় সব জায়গা থেকেই প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন সঞ্জীব। অবশেষে পরিবারের লোকেরাই এগিয়ে এসেছিলেন তাঁর স্বপ্নপূরণে। বর্তমানে সেখানে প্রাণীর সংখ্যা তিনশোরও বেশি। কুকুর, গাধা, সাপ থেকে শুরু করে কী নেই সেখানে। ভারতের বিয়ারম্যান কার্তিক প্রভু থেকে শুরু করে বহু বিখ্যাত বন্যাপ্রাণ সংরক্ষকই যোগ দিয়েছেন তাঁর সঙ্গে।
তার আগে অবশ্য বেশ কয়েকটি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের সঙ্গে জড়িত সংগঠনের সঙ্গে কাজ করেছেন সঞ্জীব। সেখান থেকে হাতে কলমে শিখেছেন সমস্ত কাজ। বন্যপ্রাণীদের উদ্ধার, তাদের যত্নআত্তি এসবের মধ্যেই মনে হয়েছিল, এমন একটা ক্লাসরুম যদি খোলা যায়, যেখানে ছোটোরা এসে বন্যপ্রাণীদের ব্যপারে জানতে পারবে, শিখতে পারবে। সেই ভাবনা থেকেই ‘প্রাণী- দ্য পেট স্যাংচুয়ারি’র যাত্রা শুরু।
সরকারি স্কুলের পড়ুয়াদের জন্য সবসময়ে খোলা সঞ্জীবের এই অভয়ারণ্য। বেসরকারি স্কুল এবং প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য অবশ্য সামান্য কিছু প্রবেশমূল্য ধার্য করেছেন সঞ্জীব। একানে শুধু যে কাছ থেকে প্রাণীদের দেখা যাবে তা-ই নয়, প্রাণীদের সম্পর্কে সমস্ত তথ্য বুঝিয়ে দিতে সেখানে রয়েছেন বেশ কয়েক জন প্রাণীবিশেষজ্ঞও। গোটা অভয়ারণ্যটা ঘুরিয়ে দেখানোর পাশাপাশি প্রাণীদের সম্পর্কে সমস্ত খুঁটিনাটি তথ্য জানিয়ে দেবেন তাঁরাই। পাশাপাশি বন্যপ্রাণীদের ছুঁয়ে দেখা থেকে খাওয়ানো, এমন স্নান করাতে পর্যন্ত পারবেন দর্শকেরা। জীবজন্তুদের যারা ভয় পান, তাঁদের জন্য রয়েছে বিশেষ সেশনের ব্যবস্থাও। কেউ যদি অভয়ারণ্যের ভিতরে রাত কাটাতে চান, সেই ব্যবস্থাও রেখেছেন সঞ্জীব। রয়েছে বন্যপ্রাণীদের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা। দর্শকেরা চাইলেই সরাসরি যুক্ত হতে পারেন সঞ্জীবের এই অভয়ারণ্যের সঙ্গে।
এর পাশাপাশি পরিবেশ দূষণ আটকাতেও বেশ কিছু পদক্ষেপ করেছেন তাঁরা। প্রাণীজাত বর্জ্য ব্যবহার করে বায়ো-গ্যাস বানানোর চেষ্টায় রয়েছেন তাঁরা। এমনকি বাগান করার বিষয়ে শিক্ষা দিতেও বেশ কয়েক জন অভিজ্ঞ রয়েছেন তাঁর স্যাংচুয়ারিতে।
আরও শুনুন: তুঙ্গে মাতৃদুগ্ধের চাহিদা, প্রায় ১১৮ লিটার স্তনদুগ্ধ বিক্রি করে নজির মহিলার
বন্যপ্রাণীদের আর মানুষের মধ্যে সেতু গড়ে তোলাটাই জীবনের লক্ষ্য সঞ্জীবের। ছোটদের ক্ষেত্রে একদম গোড়া থেকেই যাতে সেটা গড়ে ওঠা, তার জন্যই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন সঞ্জীব ও তাঁর দলবল। পৃথিবীটা যে শুধু মানুষেরই নয়, তার অবিচ্ছেদ্য অংশ পশু-পাখি, গাছপালা সব্বাই, সেই শিক্ষাটাই নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে চান সঞ্জীব।