সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির সমালোচনা করে বারে বারেই কলম ধরেছেন সে সময়ের সাহিত্যিকেরা। নিন্দা করেছেন, প্রতিবাদ করেছেন, বিচার চেয়েছেন। কিন্তু সমাজের অন্য বহু স্তরের মানুষের চাইতে সাহিত্যিকেরাই যে সরব হয়েছেন আগে, ইতিহাস সে সাক্ষ্য বয়ে চলে। অন্যায়ের প্রতিবাদ কিংবা শাসকদলের বিরোধিতা করে কলম ধরবার দায়ে কত সময়ে প্রাণও হারাতে হয়েছে লেখকদের। কিন্তু সমাজে ঘটে চলা উত্থান-পতনের উপর ভিত্তি করেই যাঁর সমস্ত লেখালিখি, তিনি কি চুপ করে থাকতে পারেন?
প্রতি বছরের ১৯ মে মুসৌরির এক সুদৃশ্য বুক ক্যাফেতে জড়ো হন রাস্কিন বন্ডের ভক্তরা; উদ্দেশ্য প্রিয় লেখকের জন্মদিন উদযাপন। লেখক সেদিন পাঠকদের মধ্যে এসে বসেন। নিজের কথা বলেন, বিস্ময় নিয়ে দেখেন নতুন প্রজন্মের পাঠকদের চোখে লেখকের প্রতি মুগ্ধতার রেশ। পদ্মশ্রী-পদ্মভূষণ প্রাপক সাহিত্যিককে তো এত কাছের করে পাওয়া যায় না সচরাচর। প্রতি বছর এ দিনটির জন্য ওঁর পাঠকেরা তাই একপ্রকার উদ্গ্রীব হয়ে অপেক্ষা করেন বললেই চলে। কিন্তু বেশ কিছু বছর ধরে চলে আসা এই নিয়ম ভাঙলেন লেখক নিজেই। জানিয়ে দিলেন, এ বছর তাঁর জন্মদিনের উদযাপন বন্ধ থাকবে। কারণ, পহেলগাঁও হামলা!
‘দ্য পেন ইজ মাইটিয়ার দ্যান দ্য সোর্ড’। সত্যিই কি? অশান্তি যখন দুই-একজন ব্যক্তিমানুষ ছাড়িয়ে গোষ্ঠী, রাজ্য কিংবা দেশস্তরে পৌঁছে যায়, তখন কি কোনও কলমের সাধ্যি আছে সে দ্বন্দ্ব থামিয়ে রাখে? তাই যুগে যুগে বারে বারে এ পৃথিবীর বুকে রক্ত ঝরে পড়েছে। বহু মানুষের প্রাণের আহুতির বদলে পাওয়া গিয়েছে স্বাধীনতা। ক্ষমতা। বিজয়। কিন্তু তা বলে কলম থেমে যায়নি কখনওই। চলতি সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির সমালোচনা করে বারে বারেই কলম ধরেছেন সে সময়ের সাহিত্যিকেরা। নিন্দা করেছেন, প্রতিবাদ করেছেন, বিচার চেয়েছেন। সে চাওয়া কতখানি ফলপ্রসূ হয়েছে, তা এখানে নিরর্থক। কিন্তু সমাজের অন্য বহু স্তরের মানুষের চাইতে সাহিত্যিকরাই যে সরব হয়েছেন আগে, ইতিহাস সে সাক্ষ্য বয়ে চলে। অন্যায়ের প্রতিবাদ কিংবা শাসকদলের বিরোধিতা করে কলম ধরবার দায়ে কত সময়ে প্রাণও হারাতে হয়েছে লেখকদের। কিন্তু সমাজে ঘটে চলা উত্থান পতনের উপর ভিত্তি করেই যাঁর সমস্ত লেখালিখি, তিনি কি চুপ করে থাকতে পারেন? ফলশ্রুতি যাই হোক, লেখককে তাঁর অবস্থান জানাতেই হয়!
সেই দলে এবার নাম লেখালেন রাস্কিন বন্ড-ও। গত মাসের শেষদিকে পহেলগাঁওয়ে বেড়াতে যাওয়া বেশ কিছু পর্যটক প্রাণ হারালেন পাকিস্তানি সন্ত্রাসবাদীদের হাতে। সে ঘটনার প্রত্যাঘ্যাত স্বরূপ ভারত পরিচালিত ‘অপারেশন সিঁদুর’ আক্রমণ করল পাকিস্তানের কয়েকটি জঙ্গি ঘাঁটি। আর এরপরই দ্রুত অশান্তির পরিবেশ তৈরি হল দুই দেশের মধ্যে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্য-সহ সাধারণ নাগরিকেরাও প্রাণ হারালেন দুই দেশের মধ্যেকার দ্বন্দ্বের জেরে। আপাতত যুদ্ধবিরতি ঘোষণা হলেও ভিতরে ভিতরে প্রতিহিংসার রেশ যে একেবারে মুছে গিয়েছে, তা বলা যায় না। পরবর্তীকালে এ থেকে নতুন কোনও সমস্যা মাথাচাড়া দেয় কি-না, তাও কেবল সময়ই বলতে পারে। এমতাবস্থায় দাঁড়িয়ে ধুমধাম করে জন্মদিন উদযাপন কি একজন সাহিত্যিককে মানায়? তাই জন্মদিনের প্রাক্কালেই ঘোষণা করে দিয়েছেন প্রবীণ লেখক, এই বছর বন্ধ থাকবে জন্মদিনের যাবতীয় আয়োজন। এ যুদ্ধে যারা বলি হলেন, তাঁদের ও তাঁদের পরিবারের প্রতি সংহতি জানিয়েই এমন পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন রাস্কিন বন্ড। আর স্বাভাবিক ভাবেই ওঁর এই সিদ্ধান্তে আলোড়ন জেগেছে পাঠকমহলে।
কেবল প্রতিবাদ অথবা বিরোধিতা নয়, কোনও সাহিত্যিকের নীরব সংহতিও যে সামাজিক প্রেক্ষাপটে কতখানি জোরাল হতে পারে, তা-ই দেখিয়ে দেন বর্ষীয়ান সাহিত্যিকের জন্মদিন না পালনের সিদ্ধান্তটি। যে অবস্থায় দাঁড়িয়ে পক্ষ নেওয়া সহজ, অথচ তাও পিছিয়ে যেতে দেখা গিয়েছে বেশিরভাগ খ্যাতনামা শিল্পীদের, সেখানে রাস্কিন বন্ডের এই সিদ্ধান্ত তাঁর দৃঢ় চেতনাবোধের প্রকাশ করে। একানব্বই বছর বয়সের দোরগোড়ায় দাঁড়ানো এই চিরকিশোর গল্পকারের পদক্ষেপটি যেন সাধারণের চেতনায় ধাক্কা দিয়ে বলে, কলম তরবারির চাইতে ধারাল না হলেও, কমও নয় কোনও অংশে!