দলিত পরিবারে জন্মেও মাথা উঁচু করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিলেন এলোমেলো চুলের ঝকঝকে হাসির যুবক। দূর আকাশের তারা আর পায়ের নিচের মাটিকে দুহাতে আঁকড়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন তিনি। সেই স্পর্ধার দোষেই মরে যেতে হয়েছিল অন্ধ্রের হায়দরাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের মেধাবী ছাত্র, গবেষক রোহিত ভেমুলাকে।
রোহিতের মৃত্যু আমাদের বিপন্ন আর বিষণ্ণ করে।
সেই বিপন্নতার কাছে ফিরলেন প্রতিভা সরকার।
এই জানুয়ারি মাসেই ঘটেছিল সেই ঘটনা। ১৭০৯ সালে। রাতারাতি বরফে ঢেকে গিয়েছিল চরাচর, তিন হপ্তা এক নাগাড়ে চলেছিল তুষারপাত, তারপর দিন কয়েকের বিরতি, আবার নাগাড়ে ঝুপ ঝুপ, পাইন গাছের বাঁকানো পাতাগুলো ডালপালাসুদ্ধ ভেঙে পড়ছিল বরফের ভারে। শুধু সমুদ্র, নদী, খাল জমে যায়নি, জমে গিয়েছিল মাটিও। কারণ এক মিটার কি তারও বেশি খুঁড়ে গেলেও শুধুই বরফ উঠে আসছিল। খোঁয়াড়ে পশুরা ঠান্ডায় জমে মরছিল দাঁড়িয়ে অথবা বসে, মোরগের মাথার ঝুঁটি জমে গিয়ে খসে পড়ছিল, বড় বড় গাছগুলোর বাকল বিস্ফারিত হয়ে ছিটকে বেরোচ্ছিল, যেন তারা খতরনাক স্প্লিন্টার অজস্র! লিখতে গিয়ে বাইরের বাতাসের সংস্পর্শে পেনের কালি কঠিন হয়ে উঠছিল, ঘরের বাইরে আসা মাত্র লোকে পা হড়কে আছড়ে পড়ছিল, আর হাট্টাকাট্টা জোয়ান সিপাহিরা নির্জন সীমান্ত পাহারা দিতে দিতে পাকা ফলের মতো টুপ করে খসে পড়ছিল মৃত্যুর কোলে।
এমন শীত কেটে যে আবার কখনও রোদ উঠবে, ফিরে আসবে প্রাণের স্পন্দন, দীর্ঘদিন এমনটা ভাবতেই পারেনি ইওরোপের মানুষজন।
এই মৃত্যুভয়াল তুষারপাতের কথা মনে পড়লেই নজরে ভেসে ওঠে একটি মুখ, ঘনিয়ে আসা বাদুলে মেঘের মতো একমাথা চুল, চোখে ঝলমল করছে বুদ্ধির দীপ্তি! না হেসে কিছুতেই থাকতে পারত না সেই ছেলে,অথচ শত চেষ্টার পরেও জন্ম নামে এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে কিছুতেই নিজেকে মুক্ত করতে না পেরে তাকে বাধ্য হয়ে বেছে নিতে হয় স্বেচ্ছামৃত্যু!
-: আরও শুনুন :-
কেন যে ওই প্রাণোচ্ছল যুবকের মৃত্যুর বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে থাকে এই ভয়াবহ শৈত্যের ছবি, তার একশো কারণ আছে। সবচেয়ে বড় কারণ হল আমাদের, মানে তথাকথিত বাবুজাতের মানসিক শৈত্য, যা মেধা আর অঢেল সুযোগের মধ্যে তফাত করতে পারে না। শহুরে কেতা আর গ্রামীণ সারল্যকে মোরগ লড়াইতে নামিয়ে দেয়, যদিও কে জিতবে সেটা বহু যুগ আগে থেকে ঠিক হয়ে আছে। সবচেয়ে ভয়াবহ, বংশমর্যাদার গৌরবে ধরাকে সরা জ্ঞান করে তথাকথিত নীচু জাতের অশিক্ষা, নিম্নমানের জীবনযাত্রার বিরুদ্ধে এরা সদাই সরব থাকে। যেন তার জন্য কেউ কোথাও বিন্দুমাত্র দায়ী নয়! সদাই নজর রাখে কোনও সুযোগকে খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরে তথাকথিত নীচু জাত যেন বিন্দুমাত্র উঠে আসতে না পারে। তাই এদের দিয়ে কিসসু হবে না, এই আওয়াজে দিকবিদিক প্রকম্পিত করে সংরক্ষণকে সব সর্বনাশের মূল ঠাওরায়।
আড়াই হাজার বছরের পুরনো এই জাতিভেদপ্রথা দক্ষিণ এশিয়ায় বহু প্রচলিত বলে লিপিবদ্ধ করে গেছেন বৌদ্ধ পরিব্রাজক ফা হিয়েন। আড়াই হাজার বছর ধরে সমাজের মলমূত্র মাথায় বয়েছে যে, সেও তো ক্লান্ত হয়! প্রজন্মের পর প্রজন্ম মৃত পশুর চামড়া ছাড়াতে ছাড়াতে ক্লান্ত হয় চামার বলে দেগে দেওয়া জনগোষ্ঠী। তাদেরও তো ইচ্ছে করে দুর্গন্ধমুক্ত এক অনাবিল জীবনের! শিক্ষা সংস্কৃতির আলোকিত পরিমণ্ডল তাদের ডাকে না? কিন্তু দেবে তাকে সমাজ সেই সুযোগ? চাইলেই সে কি মানসিকতা বা মেধার জোরে অর্জন করতে পারবে তথাকথিত উচ্চবর্ণের সম্মানিত জীবনযাত্রা?
সরকারি চাকরি এখন আর কটা? কর্পোরেটের চাকরিতে বিজাতীয় ভাষা, আদবকায়দা রপ্ত না থাকলে দলিত বা বাবুজাত, কারোরই চাকরি হয় না, সংরক্ষণ প্রথাও সেভাবে নেই। এসব জেনেবুঝে যারা রিজার্ভেশনকে সমস্যার মূল বলে মানে, রাষ্ট্রের সঙ্গে সঙ্গে তাদের হাতেও লেগে আছে রোহিতের রক্ত। বড়লোকের ছেলেমেয়েরা যখন ক্যাপিটেশন ফি দিয়ে, টাকার জোরে আসন বা চাকরি দখল করে, তখন কোথায় থাকে তাদের জাতিবাদী সমালোচনা?
রোহিত এইসবই জানত। জানত ঐকান্তিক চেষ্টার পরও তার জীবন পরিত্রাণহীন। অথচ একই উষ্ণতায় সে ভালোবেসেছিল মানুষ আর প্রকৃতিকে, এ কথা না জেনেই যে মানুষেরই প্রভুত্বকামিতা আর অপরিসীম লোভ মানুষকে পরিণত করেছে ভোটের বাজারে শুধুমাত্র একটি সংখ্যায়। সে ক্ষমতালোভীকে জিতিয়ে আনতে পারে। কিন্তু ক্ষমতাহীনের ক্ষত নিরাময় করতে পারে না।
অথচ তাই তো হবার কথা ছিল। কারণ রোহিত জানত, বিশ্বাস করত, মানুষ গঠিত নক্ষত্রচূর্ণে। কত প্রাচীন সুপারনোভার বিস্ফোরণে পর, কত বামন তারার প্রসারিত হতে হতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে মহাকাশে ছড়িয়ে যাওয়া নাক্ষত্রিক অণু পরমাণুতে গঠিত এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। মানুষও তার ব্যতিক্রম নয়। অথচ অলৌকিক মহিমাবিচ্যুত আমরা কেবলই আয়ত্ত করে নিয়েছি নিষ্ঠুরতা, ক্ষমতালিপ্সা আর ঘৃণা।
হায়দ্রাবাদ ইউনিভার্সিটির গবেষক রোহিত ছিল দলিত ঘরের সন্তান। তার স্কলারশিপের টাকা বন্ধ করে, হস্টেল থেকে বহিষ্কার করে, নৈরাজ্য সৃষ্টির মিথ্যে অপবাদ দিয়ে তাকে আত্মহননের পথে ঠেলে দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রত্যক্ষ মদতে।
সত্যি কি তবে এই একবিংশ শতকেও কোন ঘরে জন্ম হল তা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ? আমরা দলিত না ব্রাহ্মণের সন্তান, সেই-ই আমাদের শেষ পরিচয়? রথের চাকা তুলতে ব্যস্ত কর্ণের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড হাজার হাজার বছর পরেও আমাদের জীবনে এখনও অভিনীত হয়ে চলবে? স্পর্ধাভরে যেই-ই বলবে, “দৈবাৎ সৎকূলে জন্ম, কিন্তু পুরুষত্ব করায়ত্ত মোর”, তাকেই শেষ করে দেবার জন্য শমীবৃক্ষের লুকোনো কোটর থেকে বার হয়ে আসবে অজস্র লুকানো আয়ুধ?
তার শেষ চিঠিতে রোহিত লিখেছিল নিজের অনাদৃত শৈশবের কথা, মেধা ও অন্যান্য ভালো গুণের কদরহীন নিকৃষ্টতম অপমানের কথা। দারিদ্র্য, বঞ্চনা আর অপমান ছিল নিত্যসঙ্গী, তবু ‘পুরুষত্ব করায়ত্ত মোর’ বলে সে কতবার তেড়েফুঁড়ে চেষ্টা করেছে, পড়ার খরচ জোগাবার জন্য মোট বয়েছে, রাজমিস্ত্রির কাজ করেছে, মেধার জোরে এসসি এসটির বদলে জেনারেল লিস্টে বারবার নিজের নাম তুলেছে। কিন্তু বাবুজাতের ঘৃণা আর অসূয়ার সঙ্গে এঁটে উঠতে পারেনি।
রোহিতের এই ভয়ংকর পরিণতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এই বিশাল দেশের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে থাকা দলিত এবং তথাকথিত নিম্নবর্ণ এবং ছোটজাতের ছেলেমেয়েদের অবস্থা, তাদের অসহায়তা। শিউরে উঠি, যখন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী সম্প্রতি সংসদে জানান, গত ৫ বছরে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, আইআইটি, আইআইএম-র মতো প্রিমিয়ার প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে আদিবাসী,তফসিলি উপজাতি ও অন্যান্য অনগ্রসর সম্প্রদায়ের ১৩ হাজার ৬২৫ জন পড়ুয়া মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে। গত ৩ বছরে মোট ৩৬ হাজার ৯৫০ জন দলিত পড়ুয়া আত্মঘাতী হয়েছে।
রাষ্ট্র, প্রশাসন, ব্যক্তিমানুষ এবং সমাজের যে ভয়ংকর মানসিক শৈত্য দেখা গেছে রোহিত ভেমুলার ক্ষেত্রে, তার সঙ্গে তুলনীয় ১৭০৯ সালের ওই মারাত্মক স্বল্পকালীন তুষারযুগ। এখনও যদি ফিরে না ভাবি, তাহলে ওই তুষারযুগই দীর্ঘায়িত হবে, ডেকে আনবে ভালোবাসা আর মনের মৃত্যু! কে না জানে, শারীরিক মৃত্যুর চাইতে তা অনেকগুণ ভয়ংকর!
এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজব বলে রোহিত ভেমুলার ছায়ায় লিখেছি এক উপন্যাস ‘রসিকার ছেলে’। প্রকাশিত হচ্ছে এই বইমেলাতেই। যেহেতু এটি জীবনীগ্রন্থ নয়, রোহিতের জীবনের নির্যাসটুকু নিয়ে এক কল্পনার ফসল, ফিকশনাল রাইটিং, তাই এ উপন্যাসের নায়ককে আমি প্রতিস্থাপিত করেছি সুদূর কর্নাটকে। সেখানে থেকেছি, জাতিভেদ প্রথাকে বোঝার চেষ্টায় কথা বলেছি অগুনতি মানুষের সঙ্গে। সঙ্গে সঙ্গে চলেছে আকর গ্রন্থের নিবিষ্ট পঠন। জোগাড় করেছি সেই সময়কার সমস্ত কাগজের ক্লিপিং। এই সব নিয়েই হয়ে উঠেছে উপন্যাসটি।
রোহিতের মৃত্যুদিনে এই কামনা, সে মৃত্যুঞ্জয় হোক। তার ত্যাগ পথ দেখাক বহু নিপীড়িতকে।