অনেকেই মনে করছেন রাজনৈতিক কারণে যে অসহিষ্ণুতা আমাদের পেয়ে বসেছে, তারও প্রতিফলন আছে ফ্যানদের এই চরিত্রবদলে। দোসর হয়েছে নেটদুনিয়ার মিম-কালচার। ব্যাঙ্গের যে শাণিত বুদ্ধি, তা এখানে দেখা যায় না। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা হয়ে ওঠে ব্যক্তি আক্রমণ। এইসব কিছুর মিশেলেই ফ্যান-সংস্কৃতি ক্রমশ প্রশ্নের মুখে পড়ছে।
কুরুচিকর ভাষায় আক্রমণ পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে। তাঁর স্ত্রী তথা চিত্রনাট্যকার জিনিয়া সেনের ছবি বিকৃত করে নেটদুনিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ। কাঠগড়ায় দেবভক্তদের একাংশ। গোপনীয়তা ভঙ্গের অভিযোগে রবীন্দ্র সরোবর থানায় এফআইআর দায়ের করেছেন শিবপ্রসাদ-জিনিয়া। আর এই ঘটনাই যেন ফ্যান বা অনুগামীদের টক্সিক সংস্কৃতি নিয়ে নতুন করে ভাবনার পরিসর তৈরি করেছে। যে কোনও দুনিয়ার ‘স্টার’দের যে অগণন অনুগামী থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। পছন্দের মানুষকে নিয়ে তাঁদের মাতামাতিও অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে তা কি মাত্রাছাড়া হতে পারে! এই প্রশ্নই ক্রমশ জোরাল হয়ে উঠছে।
সাম্প্রতিক অতীতে এই টক্সিক ফ্যান কালচার বারেবারেই চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে। বাংলার এই ঘটনা ব্যতিক্রম নয়। ‘থাগস অফ হিন্দুস্তান’ ছবির জন্য আমির খানকে ট্রোলিংয়ের মুখে পড়তে হয়েছিল। ‘পদ্মাবৎ’ বা ‘দিলওয়ালে’ ছবির গেরুয়া গান নিয়ে যে বিতর্ক ঘনিয়ে উঠেছিল সেখানে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়র। শুধু সিনেমাজগতে নয়, সাম্প্রতিক অতীতে দেখা গিয়েছে বিরাট কোহলিকে সমর্থন করতে গিয়ে সুনীল গাভাসকরকের মতো কিংবদন্তিকেও দুটো কটূ কথা বলতে ছাড়েননি বিরাট-ভক্তরা। এ যেন এমন এক সংস্কৃতি, যেখানে প্রিয় তারকার নামে বিন্দুমাত্র সমালোচনা শুনতে কেউ নারাজ। আবার অনেক ক্ষেত্রে সমালোচনারও দরকার হয় না। স্রেফ উন্মাদনার বশেই এমন সব কাজ করতে থাকেন ফ্যানরা, যা অনেক সময় শালীনতার সীমা অতিক্রম করে যায়।
অথচ এই উন্মাদনা তো নতুন কিছু নয়। আর ফ্যানেদের মধ্যে চাপা রেষারেষিও চিরকালেরই। সে ইস্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগান ফ্যানেদের অম্লমধুর ঝগড়াঝাটির কথা ধরা যাক বা উত্তম বনাম সৌমিত্র ফ্যানদের বৌদ্ধিক যুক্তি-তক্কো-গপ্পো। পছন্দ আর অপছন্দের দ্বন্দ্ব থাকাই সংগত। তবে, তা কখনই একটি নির্দিষ্ট পরিসরের বাইরে বেরোয় না। এ দেশ বিগ্রহ-পুজো ভালোবাসে। তাই অমিতাভ বচ্চন অসুস্থ হলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যজ্ঞ অব্দি শুরু হয়ে যায়। তবে সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে সেই ফ্যানডমের চরিত্র অনেকটাই বদলেছে। সোশ্যাল মিডিয়া এমন একটা কাচের দেওয়াল, যেখানে তারকার সঙ্গে যে প্রার্থিত দূরত্ব, মনে হয় তা যেন অনেকটাই কমে গিয়েছে। ফলে তারকার সঙ্গে যোগাযোগের এক অন্যরকম বাস্তবতা তৈরি হয়। সংযোগ আরও নিবিড় হয়ে ওঠে। আর সেই সুবাদেই যেন ফ্যান-সংস্কৃতিও অন্য মাত্রা পেতে শুরু করে।
তারকার ফ্যানদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন, তাঁরা বলছেন, তারকা আদতে হয়ে ওঠেন বাস্তবের যন্ত্রণামুক্তির আফিম। খর্খরে বাস্তবতা থেকে খানিকক্ষণের জন্য মুক্তি পাওয়ার এক এসকেপ রুট। দেখা গিয়েছে, যাঁদের নিজস্ব যন্ত্রণা আছে – সামাজিক বা অর্থনৈতিক যে কোনও ধরনের হতে পারে – তাঁরা আরও বেশি করে এই পথ খুঁজে বেড়ান। অপ্রাপ্তি, বঞ্চনা, হতাশা, অবসাদ থেকে বেরিয়ে আসার বাস্তব পথ আপাতরুদ্ধ মনে হলে, চটজলদি খুঁজে নেওয়া যায় এই স্বর্গ আর স্যারিডন। এক একটি ক্ষেত্রের তারকাদের যে অযুত ভক্ত, তা যেন প্রকারন্তরে একটি করে সম্প্রদায়ের রূপ পায়। তারকারা জানেন, তাঁদের ভক্তদের কথা। অনুগামীদের সন্তুষ্ট করে রাখতেই তাঁরা চেষ্টা করেন। কিন্তু একজন ভক্ত তারকার সঙ্গে যে সম্পর্ক স্থাপন করে নেন তা মূলত একমাত্রিক। একমুখী সম্পর্ক। একজন তারকা জনে জনে ভক্তের সঙ্গে সেরকম নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন না। ফলত ফ্যানদের এই ধরনের একরৈখিক সম্পর্ক, যা প্যারাসোশ্যাল রিলেশনশিপ হিসাবে পরিচিত, তা একজন ফ্যানকে বাস্তবিক অন্যরকম করে তোলে। এই সম্পর্ক কি খারাপ? এক কথায় তা বলা যায় না। যদি না কোনও ফ্যান তাঁর এই সম্পর্কের ধারণার জেরে এমন কিছু করে না বসেন, যা আদতে সামাজিক ভাবে গর্হিত।
তারকা বা তাঁর টিম ফ্যানদের এই নতুন চরিত্র সম্পর্কে যে অবহিত নন, তা কিন্তু নয়। তাঁদের তরফ থেকেও যথেষ্ট যোগাযোগ রক্ষা করা চেষ্টা করা হয়। কেননা ফ্যানদের সঙ্গে এই সম্পর্ক একটি ছবি বা পণ্যের প্রচারে সহায়ক হয়ে ওঠে। আধুনিক সময়ে তা জরুরি বলেই তারকা ও ফ্যানদের যোগাযোগের ধরনেও অনেক বদল এসেছে। সোশ্যাল মিডিয়া যে অ্যাটাচমেন্টের সুযোগ এনে দেয়, তা কাজে লাগানো হয় ব্যবসায়িক ক্ষেত্রেও। তা একদিক থেকে সদর্থক। তার একটি খারাপ দিক হল ফ্যানদের উন্মত্তের মতো আচরণ। প্রায় সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে ঝামেলার মতোই তাঁরা একে অন্যের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়ে বসেন। এমনকী অন্য তারকাকে ছোট করতে আগুপিছু না ভেবেই গর্হিত কাজ করে ফেলেন। এমনকী তাতে তাঁদের তারকারও ক্ষতি হয়। এই টক্সিক ফ্যান-কালচার যে কতদূর যেতে পারে শাহরুখ খানের ‘জাবরা ফ্যান ছবিটিতে তার খানিক আভাস মেলে।
অনেকেই মনে করছেন রাজনৈতিক কারণে যে অসহিষ্ণুতা আমাদের পেয়ে বসেছে, তারও প্রতিফলন আছে ফ্যানদের এই চরিত্রবদলে। দোসর হয়েছে নেটদুনিয়ার মিম-কালচার। ব্যাঙ্গের যে শাণিত বুদ্ধি, তা এখানে দেখা যায় না। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা হয়ে ওঠে ব্যক্তি আক্রমণ। এইসব কিছুর মিশেলেই ফ্যান-সংস্কৃতি ক্রমশ প্রশ্নের মুখে পড়ছে। ভালো-মন্দ, পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে সরব য কেউ হতেই পারেন। পছন্দের তারকাকে আলাদা করে ভালো কেউ বাসতেই পারেন। কিন্তু তা অসামাজিক হয়ে উঠতে পারে না কখনোই। এই সহজ সত্যিটা বিস্মৃত হলে, ফ্যানরা তাঁদের ভালোবাসা সত্ত্বেও আদতে গুরুত্ব হারাবেন।
ফ্যানডম আফিম হয়ে উঠলে ফ্যান আর ফ্যান্টাস্টিক হবেই-বা কী করে!