জ্ঞানবাপী বিতর্কে সম্প্রতি তোলপাড় হয়েছে দেশ। ফের উঠে এসেছে বিদেশি আগ্রাসনে দেশের মন্দির ধ্বংসের ইতিহাস। ভারতবর্ষের ভাগ্যে বারবার ঘটেছে এই ট্র্যাজেডি। তবে সেই সঙ্গে ইতিহাসে লেখা আছে এমন ব্যক্তিত্বের কথাও, যাঁরা সমসময়ে আগলেছেন এই মন্দিরগুলিকে। বাঁচিয়েছেন ধ্বংসের হাত থেকে, করেছেন পুনর্নির্মাণ। তেমনই একজন রানি অহল্যাবাই হোলকার। আসুন শুনে নিই এই মহীয়সী রমণীর কথা।
কাশীর বিশ্বনাথ মন্দির হোক কি গুজরাটের সোমনাথ মন্দির- এসব চত্বরের আশেপাশে কান পাতলেই শোনা যায় সেই রানির গল্প। বলা যায়, এই মন্দিরগুলিকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন তিনি-ই। রক্ষা করেছিলেন দেশের সম্পদ। ভারতবর্ষে মন্দির ধ্বংসের ইতিহাস নতুন নয়। সময়ের কারণে বা নির্দিষ্ট রাজশক্তির অবসানের দরুন কোনও কোনও মন্দির হত জীর্ণ। আর সে সময় মন্দিরগুলি ছিল অন্যতম অর্থনৈতিক কেন্দ্রও। ফলে বহিরাগত আগ্রাসনের টার্গেট হত মন্দিরগুলিই। যেমন, সোমনাথ মন্দির। আবার বিধর্মী শাসকরা নিজেদের ধর্মের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতেও মন্দির ধ্বংসের পথই বেছে নিতেন। কাশীর বিশ্বনাথ মন্দিরের ক্ষেত্রেও লুকিয়ে আছে এমন ইতিহাস-ই। কারণ যা-ই হোক না, প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই ধ্বংসের মুখে-পড়া মন্দিরগুলির পুনর্নিমাণের ব্রত যিনি নিয়েছিলেন, তিনি রানি অহল্যাবাই হোলকার।
আরও শুনুন: রুখে দিয়েছিলেন মহম্মদ ঘোরির জয়রথ, পৃথ্বীরাজই কি ভারতের শেষ হিন্দু শাসক?
শোনা যায়, স্বামীকে হারানোর পর সতী হতে চলেছিলেন অহল্যাবাই। সে সময় তাঁর শ্বশুরমশাই পথরোধ করে দাঁড়ান। সেদিনই সম্ভবত লেখা হয়েছিল ইতিহাসের এক ভিন্নতর অধ্যায়। রানি তাঁর ক্ষমতা অনুযায়ী শাসনব্যবস্থা পরিচালনা তো করেইছিলেন, পাশাপাশি রাজধর্মের এমন স্বাক্ষর রেখেছিলেন, যা আজও স্মরণীয়।
আরও শুনুন: রাম সেতুর অস্তিত্ব কি সত্যি আছে? তথ্য আর যুক্তি কোন ইঙ্গিত দিচ্ছে?
এককালে অনেক মারাঠা শাসকেরই স্বপ্ন ছিল বহিরাগত আগ্রাসনে ক্ষতিগ্রস্ত কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরকে নতুন করে গড়ে তোলার। কিন্তু সেই স্বপ্নকে বাস্তব করেছিলেন আঠেরো শতকের রানি অহল্যাবাই হোলকার-ই। আর শুধু এই দুটি মন্দিরই নয়, এ দেশের প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থানেই কিছু-না-কিছু অবদান রয়ে গিয়েছে তাঁর। পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দির, গুজরাটের দ্বারকা, উত্তরের কেদারনাথ মন্দির থেকে দক্ষিণ ভারতের রামেশ্বরম- মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সবসময় এগিয়ে এসেছেন এই ধার্মিক রানি। যে কোনও দাতব্য কাজেই তিনি ছিলেন অগ্রণী। শুধু নিজের রাজ্য বা শাসনক্ষেত্রের পরিধির মধ্যে রানি নিজেকে আটকে রাখেননি। তাঁর দয়া-দানের ঐশ্বর্য ছড়িয়ে পড়েছিল দেশের সর্বত্রই। কিন্তু এই যুগে দাঁড়িয়ে তা যেন বড় আশ্চর্য মনে হয়। রানিমার উদ্যোগের পিছনে ধর্ম নিশ্চিতই ছিল, কিন্তু তা প্রতিষ্ঠায় ছিল না কোনওরকম হিংসার আশ্রয়। বরং ধর্ম কথার অর্থ যে ধারণ করা, সেই বৃহত্তর অর্থটিকেই সযত্নে লালন করেছিলেন তিনি।
আরও শুনুন: বারংবার বাংলায় বিদেশি আক্রমণ, রুখতে হিন্দু রাজাদের মতো লড়েছিলেন মুসলমান রাজাও
সাম্প্রতিক কালে দেশজোড়া মন্দির-মসজিদ বিতর্ক উসকে দিয়েছে জ্ঞানবাপী কাণ্ড। তবে এই একটিমাত্র মসজিদেই নয়, দেশের আরও একাধিক মুসলিম ধর্মস্থানে হিন্দু অনুষঙ্গ রয়েছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে যে মন্দিরগুলি কখনও না কখনও বিধর্মী শক্তির আক্রমণের মুখে পড়েছে, এই পরিস্থিতিতে সেগুলি হয়ে উঠেছে বিতর্কের ইস্যু। আর সেই কারণেই শিরোনামে উঠে এসেছে গুজরাটের সোমনাথ মন্দিরও, যে মন্দিরটি একাধিকবার গজনির সুলতান মামুদের হামলা সহ্য করেছে। এই মন্দির পুনর্নিমাণের ক্ষেত্রেও এগিয়ে এসেছিলেন সেই অহল্যাবাই।
আজও দেশের মানুষ সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করেন এই মহীয়সী নারীকে। ধর্মরক্ষায় যেরকম উদারতার পরিচয় তিনি দিয়েছলেন, তাই-ই যেন এখনও আমাদের চিনিয়ে দেয় সনাতন ভারতবর্ষের আত্মাটিকে।