আসলে একটা আলু। তবে তা খাওয়া যাবে না। বলা ভালো, খাওয়ার অধিকার নেই। ভক্তিভরে তার পুজো করতে হবে। কারণ, এমনটাই সবাই করছেন। সেইভাবে আপত্তিও তুলছেন না কেউ। বরং কেউ প্রশ্ন করলে বলছেন, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু…! আসুন শুনে নেওয়া যাক।
রাস্তার ধারে পড়ে থাকা সামান্য এক পাথর। বারবার হোঁচট খাওয়া তা সরানোর চেষ্টা করছেন কথক। এই দিয়েই গল্পের শুরু। এটুকু পড়ে ওই পাথরটিকে সামান্য বা সাধারণ তকমা দেওয়া যেতেই পারে। কিন্তু গল্প যত এগোবে পাথরটি সম্পর্কে ধারণাও তত বদলাতে থাকবে। একটা সময়ের পর, সেই সামান্য পাথর হয়ে উঠবে দেবতা। পাথরের দেবত্ব নিয়ে খোদ লেখকের মনেও প্রশ্ন জন্মাবে!
শিবরাম চক্রবর্তীর লেখা দেবতার জন্ম গল্পটি, নিছকই গল্প নয়। বাস্তবে এই ভুরি ভুরি উদাহরণ চোখে পড়ে। জনপ্রিয় বলিউড সিনেমা ‘পিকে’-তেও এমন এক দৃশ্য রয়েছে। কলেজের গেটের সামনে টকটকে লাল পানের পিক লেপে একটা পাথর বসিয়ে দেওয়া হল। সামনে কয়েকটা খুচরো কয়েন, ১০ টাকার নোট। ব্যস, ওইটুকু বিনিয়োগ যথেষ্ট। কিছুক্ষণের মধ্যে, ভিড় জমতে শুরু করল। ওই পাথর আদৌ দেবতা কি না, সেসব নিয়ে ভাবার আগেই তার সামনে মাথা ঝুঁকিয়েছেন অনেকে। কেউ কেউ সাষ্ঠাঙ্গে প্রণাম অবধি করছেন। সামর্থ্য মতো খুচরো টাকা দিয়ে যাচ্ছেন। সিনেমায় এমনটা মজার ছলে দেখানো হলেও, বাস্তবে এমন ঘটনার সাক্ষী থেকেছেন অনেকেই। কেউ কেউ মনে প্রাণে বিশ্বাসও করেন, এমনভাবেই দেবতার জন্ম হয়!
ঠিক যেমনটা বিশ্বাস করছেন, যোগীরাজ্যের বরেলি অঞ্চলের বাসিন্দারা। সম্প্রতি সেখানকার এক চাষী তাঁর ক্ষেত থেকে বিশেষ আকৃতির একটি আলু তুলেছেন। সাধারণ ঘটনা, প্রকৃতির নিয়মে এমনটা হতেই পারে। তবে বিষয়টা সাধারণ মনে হয়নি ওই চাষির। তাই আলু হাতে সোজা হাজির হন স্থানীয় মন্দিরে। সেখান থেকেই গল্পের শুরু। আলুটি হাতে নিয়ে দীর্ঘক্ষণ পরীক্ষা করে মন্দিরের পুরোহিত বলেন, এই আলু মোটেও সাধারণ নয়। বরং এতে একইসঙ্গে বিষ্ণুর চারটি অবতারের প্রতীক ধরা পড়ছে। ঠিক কী দেখে ওই পুরোহিত এমনটা বুঝলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না, কারণ ততক্ষণে একথা গোটা এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। তাতে আলু চাষি রাতারাতি হলেন সেলিব্রিটি, এবং তাঁর ক্ষেতের আলু হল দেবতা। যে সে দেবতা নয়, একেবারে বিষ্ণুর অবতার। নিয়মিত পুজো-পাঠ, আরতি, ভোগ, সবই হতে থাকল আলুটিকে সামনে রেখে। বিষ্ণু স্বয়ং কৃপা করে এই মন্দিরে অবতীর্ন হয়েছেন, এমনটাই এলাকাবাসীর ধারণা। তাই দলে দলে সকলে ভিড় জমাতে শুরু করেছেন ইতিমধ্যেই। এই ঘটনার সঙ্গে বিশেষ বিশেষ দৈব যোগ-এর প্রসঙ্গ জুড়ছেন সেখানকার মুরুব্বিরা। কেউ কেউ এই দাবিও তুলছেন, এ হল বিষ্ণুর আগামী অবতার, ‘কল্কি’ আগমনের ইঙ্গিত। তাই সিংহাসনে রাখে আলুর সামনেই ভক্তরা মাথা ঠুকছেন, মানত করছেন, কেউ কেউ দাবি করেছেন ‘বিশেষ উপকার হয়েছে’। সেসব কতটা সত্যি, তা নিয়ে তর্ক জমতেই পারে। কিন্তু কে করবেন তর্ক?কিছু বললেই উত্তর আসবে-বিশ্বাসে মিলায় বস্তু!
যে দেশে স্রেফ এই বিশ্বাসের কাঁধে ভর করে, গোটা একটা কুম্ভমেলা হতে পারে, সেখানে এমন ঘটনাকে স্বাভাবিক মেনে নেওয়াই ভাল। তবে ধর্মকে সামনে রেখে কিছু মানুষ যেভাবে ব্যবসা ফাঁদছেন, তা মেনে নেওয়া হয়তো যুক্তিযুক্ত নয়। তবু উপায় কী! যা হচ্ছে তা জনতার ইচ্ছায়, জনতার স্বার্থে, জনতাকে সাক্ষী রেখেই হচ্ছে। আলুকে দেবতা মানতে আপত্তি নেই অনেকেরই। তাই যতই গল্প লেখা হোক বা সিনেমায় দেখানো হোক, বাস্তবটা এখনও এতটুকু বদলায়নি। এবং ভবিষ্যতে যে এমন ঘটনা আবার ঘটবে একথাও অনায়াসে বলা যায়।