তাজমহলের ভিতরেও নাকি রয়েছে হিন্দু মন্দিরের অস্তিত্ব। এমনই দাবি করে আদালতের জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছেন এক ব্যক্তি। তাজমহলের ভিতরে থাকা ২২টি বন্ধ ঘরে সমীক্ষা চালানোরও দাবি জানান তিনি। যদিও সেই দাবি খারিজ করে দিয়েছে আদালত। এই যে তাজমহলকে ঘিরে বাতাসে ঘুরছে ‘তেজো মহালয়া’ তত্ত্ব, তার নেপথ্যে কিন্তু হিন্দুত্ববাদীরা নন, রয়েছেন অন্য কেউ। কার মস্তিস্কপ্রসূত এই ভাবনা, আসুন জেনে নেওয়া যাক।
কোন কোন মসজিদের ভিতরে রয়ে গিয়েছে মন্দিরের অস্তিত্ব, তা খুঁজে পেতে উঠেপড়ে লেগেছে দেশের হিন্দুত্ববাদী দলগুলি। একাধিক মামলা জড়ো হয়েছে দেশের একাধিক আদালতে।
মন্দির-মসজিদ বিতর্ক বোধহয় আজকের নয়। সেই বাবরি মসজিদ থেকে শুরু করে আজকের জ্ঞানবাপী মসজিদ বিতর্ক। কৃষ্ণজন্মভূমি না ইদগাহ মসজিদ তা নিয়েও চলছে মামলা। এরই মধ্যে আবার দানা বেঁধেছে তাজমহল নিয়ে নয়া বিতর্ক।
আরও শুনুন: ‘জনস্বার্থ মামলাকে প্রহসনে পরিণত করবেন না’, তাজমহলের বন্ধ ঘর খোলার আবেদন খারিজ আদালতে
পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম এই তাজমহল নাকি আদতে ছিল হিন্দু মন্দির ‘তেজো মহালয়া’। হিন্দুদের মন্দিরের জায়গা দখল করেই এই তাজমহল বানিয়েছিলেন মুঘল সম্রাট শাহজাহান, এমনটাই অভিযোগ একদল হিন্দুত্ববাদীর। অথচ ইতিহাস বলে, প্রিয়তমা স্ত্রী মমতাজমহলের স্মৃতির উদ্দেশে এই স্থপতিটি বানিয়েছিলেন শাজাহান। এখানেই শায়িত রয়েছে তাঁদের দেহ।
তাজমহলের ভিতরে বন্ধ অবস্থায় অন্তত ২২টি ঘর রয়েছে। সেই সব ঘরে হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে বলেই দাবি একটি পক্ষের। সেইসব ঘরে কী আছে, তা প্রকাশ্যে আনার জন্যই আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন বিজেপির অযোধ্যা ইউনিটের মিডিয়া-ইন-চার্জ রজনীশ সিংহ। যদিও সেই আরজি কার্যত উড়িয়ে দিয়েছে ইলাহাবাদ আদালত। জনস্বার্থ মামলায় অপব্যবহারের অভিযোগ তুলেও তাঁকে তীব্র ভর্ৎসনাও করেন বিচারপতি।
সম্প্রতি আর্কিওলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার তরফেও জানানো হয়, ২২টি কেন, তাজমলে বন্ধ অবস্থায় একশোরও বেশি ঘর রয়েছে। এবং তাতে কোনও হিন্দু দেবদেবী নেই বলেই সাফ জানিয়ে দিয়েছে পূরাতাত্বিক সর্বেক্ষণ। তবে তাতেও বিতর্কে রাশ টানা যায়নি।
আরও শুনুন: ‘হিন্দুরাষ্ট্র করে দিলেই সব সমস্যার সমাধান!’ কেন্দ্রকে একহাত নিলেন যশবন্ত সিনহা
এই যে তাজমহল নিয়ে এত বিতর্ক, তার সূত্রপাত কোথা থেকে হয়েছিল জানেন? হিন্দুত্ববাদীরা নন, এই ভাবনা কিন্তু ভাবা হয়েছিল অনেক বছর আগে। যার নেপথ্যে ছিলেন পুরুষোত্তম নাগেশ ওক নামে ব্যক্তি। লোকে তাঁকে চিনত পিএন ওক নামেই। এই যে ‘তেজো মহালয়া’ নামক বিতর্কিত তত্ত্ব, তা কিন্তু উদ্ভাবিত হয়েছিল তাঁর মাথা থেকেই। ইন্দোরের একটি মরাঠা পরিবারে জন্ম পি এন ওকের। ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির হয়ে লড়েছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। পরে অবশ্য যুদ্ধ ছেড়ে সাংবাদিকতায় আসেন তিনি। কাজ করেছিলেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকেও।
১৯৬৪ সাল নাগাদ ‘ইনস্টিটিউট ফর রিরাইটিং ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন ওক। ইতিহাসকে গড়েপিটে নিজের মতো করে একটা ব্যাখ্যা তৈরি করার চেষ্টা করাই ছিল যার উদ্দেশ্য। এ বিষয়ে প্রচুর বইও লিখেছিলেন তিনি। তেমনই একটি তত্ত্ব এই ‘তেজো মহালয়া’।
আরও শুনুন: শহিদ হয়েছিলেন স্বামী, শিক্ষকতা ছেড়ে তবু ভারতীয় সেনাতেই যোগ দিলেন স্ত্রী
১৯৮৯ সালে ‘তাজমহল: দ্য ট্রু স্টোরি’ নামে এই সম্পর্কিত একটি বইও লেখেন ওক। তাঁর লেখা বইগুলির মধ্যে সব চেয়ে জনপ্রিয় ছিল এটি। সেখানে ওক দাবি করেছেন, রানী মমতাজ বেগমের সমাধিস্থল নয়, তাজমহল আদতে প্রাচীন একটি শিব মন্দির। যার নাম ছিল ‘তেজো মহালয়া’। জয়পুরের মহারাজা জয় সিংহের থেকে সেই মন্দিরটি দখল করে সেখানে মমতাজবেগমের সমাধি বানিয়েছিলেন সম্রাট শাহজাহান।
নিজের এই তত্ত্বের উপর ভর করে ২০০০ সাল নাগাজ সুপ্রিম কোর্টে একটি আবেদনও করে বসেন ওক। শীর্ষ আদালত যাতে তাজমহলকে হিন্দুদের ঘোষণা করে দেয়, এই মর্মে আরজিও জানান তিনি। তবে সেই আবেদন পত্রপাঠ খারিজ করে দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। ২০০৭ সালে ওক মারা গেলেও, তাঁর এই তত্ত্বের ব্যাটন হাতে তুলে নেন হিন্দুত্ববাদীরা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাতে লেগেছে রং। যে যার মতো করে তাতে মশলা যোগ করতে করতে এগিয়েছেন।
শুধু তাজমহল নিয়েই নয়, ভ্যাটিকান সিটি থেকে শুরু করে কাবা, এমনকি ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবি ও নত্রে দামের মতো স্থপতি নিয়েও নিজের বিশেষ ‘তত্ত্ব’ ছিল ওকের। সেগুলোকেও আদতে হিন্দু মন্দির বলেই দাবি করেছিলেন তিনি তাঁর গবেষণায়। এমনকি খ্রিস্টান ও ইসলাম দুটি ধর্মই হিন্দধর্মের শাখা বলেও দাবি করেন ওক। তাঁর মতে কৃষ্ণ থেকেই খ্রিস্ট ধর্মের উদ্ভব। খ্রিস্টানিটি নয়, এর আসল কথাটি হল কৃষ্ণনীতি। আর ওকের এই সব তত্ত্ব শিরোধার্য করে আজও আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছেন হিন্দুত্ববাদীরা। তবে বিশ্বাসে তো মিলিয়ে যাওয়ার জিনিস এই বিতর্ক নয়, তাই শেষ কথা বলবে দেশের বিচারব্যবস্থাই।