সালটা ২০১৬। জঙ্গি আক্রমণে ত্রস্ত আফগানিস্তানের ভারতীয় দূতাবাস। ঘটনায় রীতিমতো চিন্তায় বিদেশসচিব এস জয়শঙ্কর। কীভাবে এই সংকটের সমাধান করা যায়, সেই ভাবনা নিয়েই বিনিদ্র রাত কাটাছে তাঁর। সেই সময় মাঝরাতে একটা ফোনকল আশ্বাস জুগিয়েছিল তাঁকে। ফোনটা এসেছিল খোদ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে। আর লাইনের ওপারে ছিলেন খোদ নরেন্দ্র মোদি। সেদিন কী এমন কথা হয়েছিল তাঁদের মধ্যে? আসুন শুনে নিই।
মাঝরাতেও প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করার লাইসেন্স রয়েছে বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের। স্রেফ কাজের প্রয়োজনে নয়। ব্যক্তিগত দরকারেও। কারণ দুজনের সম্পর্কটা একদিনের নয়। সেই সম্পর্কের শুরু ইউপিএ জমানায়। তখন নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী। সেই সময় তাঁকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছিলেন তৎকালীন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত এস জয়শঙ্কর। যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বলা যেতে পারে, মোদির বেজিং সফরের কথা। জানা গিয়েছিল, জয়শঙ্করের সাহায্যেই এই সফরে গিয়ে একাধিক বিদেশি বিনিয়োগের খোঁজ পেয়েছিলেন মোদি।
আরও শুনুন: মন্দিরে ঢুকে শিবলিঙ্গে চাদর চড়ানোর চেষ্টা মুসলিম যুবকদের, শোরগোল ঘটনায়
বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আমূল বদলেছে। কিন্তু মোদির সঙ্গে একইরকম সম্পর্ক রয়ে গিয়েছে এস জয়শঙ্করের। নরেন্দ্র মোদি দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর কেন্দ্র সরকারের বিদেশমন্ত্রীর পদে নিযুক্ত হয়েছেন জেএনইউ-এর এই প্রাক্তনী। অবশ্য এই কাজের জন্য যে জয়শঙ্করের মতো যোগ্য লোক মেলা ভার, সে কথা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন মোদির পক্ষ-বিপক্ষ দুদিকের রাজনীতিকরাই। আর হবে নাই বা কেন। শুধুমাত্র ব্যক্তি জয়শঙ্কর নন, তাঁর পরিবারও তো প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে দেশের সেবায় নিযুক্ত। বাবা ছিলেন বিখ্যাত কূটনীতিক, দাদা আইএস অফিসার, পরিবারের আরও একাধিক সদস্য দেশের শীর্ষ স্থানীয় আমলার পদে নিযুক্ত। নিজের জীবনের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে, জয়শঙ্কর এমনটাও বলেছেন, যে তাঁর পরিবারে ছোটবেলা থেকেই দেশসেবার কাজে যুক্ত থাকার শিক্ষা দেওয়া হয়। তাঁরা বড়ই হন এই আদর্শ নিয়ে, যে একদিন দেশের প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকবেন। তা এমন একজন মানুষকে দেশের প্রধানমন্ত্রীর গুরুত্ব দেওয়াটাই স্বাভাবিক। দীর্ঘদিন ধরে ভারত সরকারের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের নেপথ্য নায়ক এই জয়শঙ্কর। একইসঙ্গে বিদেশনীতি নিয়েও যথেষ্ট ওয়াকিবহাল তিনি। তাঁর নেতৃত্বেই বিশ্বের দরবারে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মাথা উঁচু হয়েছে ভারত সরকারের। দেশের প্রতি বিরুদ্ধাচরণও এতটুকু বরদাস্ত করেন না তিনি। মোদি তথ্যচিত্র থেকে পাকিস্তানের বিদেশমন্ত্রীর মোদিকে নিয়ে কটাক্ষ, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিকূল পরিস্থিতি তৈরি হলে তার যোগ্য জবাব দিতে দুবার ভাবেন না জয়শঙ্কর। আর এইসব কারণেই মোদির অন্যতম ভরসার জায়গা তিনি।
আর সেই সম্পর্কের খাতিরেই বোধহয় মাঝরাতেও প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করতে পারেন তিনি। এক টিভি ইন্টারভিউতে নিজেই সে কথা জানিয়েছেন জয়শঙ্কর। কী কারণে দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মাঝরাতেও কথা বলতে হয়েছিল তাঁকে, তার সবটাই জনসমক্ষে বলেছেন তিনি।
আরও শুনুন: বিজেপির ঔদ্ধত্যের জবাব দিয়েছে জনতা, কর্ণাটক নিয়ে চাঁচাছোলা মন্তব্য রাজ ঠাকরের
ঘটনাটা ২০১৬ সালের মাঝামাঝি। সেই সময় জয়শঙ্কর বিদেশমন্ত্রীও নন। বিদেশসচিব তিনি। আফগানিস্তানের মাজার-ই-শরিফ শহরে সেসময় রীতিমতো তাণ্ডব চালাচ্ছে জঙ্গিরা। এমনকি আফগানিস্তানের ভারতীয় দূতাবাসও আক্রমণ করেছে তারা। ঘটনায় রীতিমতো উদ্বিগ্ন জয়শঙ্কর। সমাধান খুঁজতে দুই দেশের কূটনৈতিক স্তরে লাগাতার আলাপ আলোচনা চলছে। তখন ঘড়িতে রাত সাড়ে বারোটা। জয়শঙ্করের ফোনে ভেসে উঠেছিল প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের নাম্বার। ভেবেছিলেন হয়তো কোনও জরুরি নির্দেশ আসবে। কিন্তু ফোন ধরেই রীতিমতো চমকে ওঠেন তিনি। কারণ লাইনের ওপারে ছিলেন খোদ নরেন্দ্র মোদি। প্রথমেই সৌজন্য দেখিয়ে মোদি জেনে নেন, তিনি জেগে আছেন কি না। সেই মুহূর্তে আফগানিস্তানের ঠিক কী পরিস্থিতি, ফোন করে সে কথাই মূলত জানতে চেয়েছিলেন মোদি। উদ্বিগ্নভাবেই তাঁকে যাবতীয় জবাব দেন জয়শঙ্কর। সব শুনে তাঁকে আশ্বস্ত করেছিলেন মোদি। শুধু তাই নয়, পরিস্থিতি ঠিক হওয়ার পর ফোন করে জানাতেও বলেন। উত্তরে জয়শঙ্কর বলেন, পরিস্থিতি ঠিক হতে আরও কয়েকঘণ্টা লাগতে পারে। তারপর প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে তিনি জানিয়ে দেবেন। কিন্তু এতে আপত্তি জানান খোদ মোদিই। তিনি বলেন, যত রাতই হোক সরাসরি যেন তাঁকেই ফোন করে জানানো হয়। পরবর্তীকালে সাক্ষাৎকারে সেই অভিজ্ঞতার কথাই জানিয়েছিলেন জয়শঙ্কর। দেশের সংকটের সময় কূটনীতিক আমলাদের পাশে দাঁড়িয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রীও যে সতর্ক ছিলেন, উপরন্তু ব্যক্তিগত স্তরে গিয়ে দিয়েছিলেন আশ্বাসের বার্তাও, সেই অভিজ্ঞতা কখনও ভোলার নয় বলেই জানিয়েছিলেন তিনি।