ধরুন , আপনাকে বলা হল একটা গোটা দিন কাটাতে হবে আপনার প্রিয় ফোনটিকে ছেড়ে। কী মনে হয়! পারবেন? নিত্যনৈমিত্তিক জিনিসপত্র কেনা থেকে শুরু করে, ক্যাব বুক করা মানে প্রায় সেই জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ- সবই আমরা আজকাল এক চুটকিতে করে ফেলি স্মার্ট ফোনের দৌলতে। কিন্তু এখন যদি আপনাকে বলি আবার ফিরে আসতে পারে সেই আগের তথাকথিত আনস্মার্ট কি-প্যাড ফোন? অবাক হবেন তো! তবে অবাক-করা হলেও অনেকেই এখন ফিরছেন সেই সাবেকিয়ানায়। কারণটা ঠিক কী? আসুন শুনে নিই।
আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে, সালটা ১৯৭৩, মটরওলা কোম্পানিতে কর্মরত জনৈক ইঞ্জিনিয়ার মার্টিন কুপার-এর হাতে আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল প্রথম চলভাষের অর্থাৎ মোবাইল ফোনের। শুনলে অবাক হবেন প্রথম ওই মোবাইল ফোনের ওজন ছিল ২ কেজিরও বেশি। আর মাত্র ২৫ মিনিট কথা বলা যেত সেই ফোনে। বর্তমান ডিজিটাল পৃথিবীতে যেখানে স্মার্ট স্লিক হালকা ফোন, যার ব্যাটারি ঘণ্টা, দিন এমনকী কোনও কোনও স্পেশাল ফোন এক সপ্তাহ পর্যন্ত চলে , সেখানে ২ কিলোর ফোন আর ২৫ মিনিট-এর ব্যাটারি ব্যাকআপ শুনে চোখ কপালে ওঠাই স্বাভাবিক। তাহলেই ভাবুন মাত্র ৫০ বছরে কী মাত্রায় অগ্রগতি হয়েছে ফোনের জগতে। এই তো বছর দশেক আগেও আমরা কি-প্যাড ফোন ব্যবহার করতাম। ফোন ধরা ছাড়া, এসএমএস করা, আর টুকটাক গেম খেলা- ব্যস ওইটুকুই দৌড় ছিল সেই সব ফোনের। না ছিল ফেসবুক-এর দৌরাত্ম, না ছিল ইউটিউবের আধিপত্য। হাতের মুঠোয় একটা ফোন ছিল ঠিকই, কিন্তু হাতের মুঠোয় তখনও ইন্টারনেট আসেনি। অনেক কিছুই ছিল না তখন ফোনে, কিন্তু যেটা ছিল ,সেটা হল সময়। মানুষের হাতে অনেক সময় ছিল, সকাle মর্নিংওয়াক ছিল, বিকেলে মাঠে খেলতে যাওয়া ছিল, পাড়ার মোড়ে, রকে বন্ধুদের আড্ডা ছিল, চায়ের দোকানে ধোঁয়া ওঠা চায়ের সঙ্গে চলা বিতর্কসভা ছিল। আজ সে সব একেবারে উঠে গেছে বা নেই বললে ভুল হবে, কিন্তু সেটা সংখ্যায় অনেক অনেক কম। আর এর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কারণ কিন্তু আমাদের হাতের মুঠোর এই স্মার্ট ফোন। রাস্তায়, মেট্রোয়, বাসে যেখানেই যান, দেখতে পাবেন ৯০ শতাংশ মানুষ নিজের ফোন নিয়ে ব্যস্ত। কেউ ফোনে ভিডিও দেখছে, কেউ হেডফোন বা ইয়ারফোনে গান শুনছে , আবার কেউ কেউ কোনও কারণ ছাড়াই ফোন স্ক্রল করে চলেছেন। ফলে আগে যে মানুষে মানুষে কথাবার্তা হত, ভাবনাচিন্তার আদান-প্রদান হত, সেটা অনেক অনেক কমে যাচ্ছে। মানুষ অনেক বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে। এমনকী বন্ধুদের আড্ডাতেও অনেক দিন পর দেখা হলেও বন্ধুদের মধ্যে বেশিরভাগ সময়ই কথা বলার কিছু থাকে না। কিছুক্ষণ কথা হওয়ার পর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় সবাই সবার ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফোন নিয়ে মানুষ আজকাল এতটাই ব্যস্ত যে রাস্তা পার হওয়ার সময়ও মানুষ ফোনে মুখ গুঁজে রাস্তা পার হচ্ছে। সম্প্রতি মোবাইল ফোনের জনক মার্টিন কুপার একটি সংবাদ সংস্থাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই প্রসঙ্গটিরই উল্লেখ করেছেন। তাঁর কথায়, তিনি রীতিমতো আতঙ্কিত হন যখন দেখেন কেউ ফোন দেখতে দেখতে রাস্তা পার হচ্ছে। এমনকী তাঁর নাতি-নাতনীদের স্মার্টফোনের অত্যধিক ব্যবহার দেখেও বেশ বিরক্তই হন তিনি।
আরও শুনুন: ঘড়িতেই প্রেশার-সুগার মাপছেন! প্রযুক্তিতে ভরসা করে হিতে বিপরীত হচ্ছে না তো?
তবে সম্প্রতি একটা সমীক্ষা কিন্তু বেশ অন্য একটা দিক তুলে ধরছে যা বেশ আশাপ্রদ। এই সমীক্ষার দাবি, অনেক মানুষই আবার পুরোনো তথাকথিত আনস্মার্ট ফোনে ফিরতে চাইছেন, নস্টালজিক ফ্যাক্টরের জন্য। যার ফলে আবার ঝুঁকছে, ফোল্ড ফোনের দিকে। বিশেষ করে যাদের বয়স ৩০ থেকে ৪০-এর কোঠায়। আর এই ট্রেন্ডকেই কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ফোন প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলিও ফোল্ড ফোন আবার তৈরি করা শুরু করেছে। মোট ৩২০০ জনের উপর সমীক্ষা চালানো হয় যারা এই মুহূর্তে ফোল্ড ফোন ব্যবহার করছেন। তাদের মধ্যে ৩৪ % মানুষের দাবি, তাঁরা এই ফোন ব্যবহার করছেন কারণ তাঁরা আবার একটু নিরিবিলি সময় চান, স্মার্টফোনের আসক্তি থেকে বেরোতে চান। ৩২% মানুষ এই ফোন ব্যবহার করছেন কারণ তাঁদের বন্ধুরাও ব্যবহার করেন। ১৮% মানুষ বলেছেন, তাঁরা তাদের ফোন হারিয়ে ফেলেছেন তাই এই ফোন ব্যবহার করছেন। আর ১৪% মানুষের দাবি এই ফোনের দাম কম তাই তাঁরা এই ফোন ব্যবহার করছেন। অর্থাৎ সমীক্ষার অধিকাংশ মানুষই কিন্তু স্মার্টফোনে থেকে দূরে থকার জন্যই আর কিছুটা নস্টালজিইয়ার কারণেই পুরোনো ফোনে ফিরে যাচ্ছেন। এই সমীক্ষায় যে ফোনগুলির কথা বলা আছে, সেগুলো ওই পুরোনো মডেলের ফোন, যা এখনকার স্মার্টফোনগুলোর থেকে দামে ৮-১০ গুণ সস্তা। এখনো অনেক কোম্পানিই পুরোনো মডেল কিন্তু নতুন ভার্সনের ফোন তৈরি করছে। এমনকী এখনও চাইলে আপনি ২০০০ সালের ফোনও ব্যবহার করতে পারেন। অনেকেই তা-ই ফিরছেন পুরনো ফোনে।